চট্টগ্রাম নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যাকে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। শনিবার (২১ ডিসেম্বর) রাতে নগরের দুই নম্বর গেট এলাকা থেকে র্যাব-৭–এর একটি দল তাকে আটক করে।
গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে র্যাব-৭ চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) এ আর এম মোজাফফর হোসাইন।
তিনি জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র-গুলিসহ এই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করে অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, চুরি ও ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে হাতেখড়ি হয় শহিদুলের। গায়ের সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা লাগিয়ে জটলা তৈরি করে মানুষের কাছ থেকে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতেন তিনি। পরবর্তীতে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন এবং নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে গড়ে তোলেন একটি নিজস্ব বাহিনী।
চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত। শহিদুলের বিরুদ্ধে ছিনতাই, অস্ত্র, চাঁদাবাজি ও মাদক সংশ্লিষ্ট অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে। চাঁদাবাজি ও এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তার একটি নিজস্ব ‘টর্চার সেল’ থাকার তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মাদক বিক্রি ও চাঁদাবাজির অর্থ দ্রুত গণনার জন্য সেখানে বিশেষ গণনার যন্ত্রও ব্যবহার করা হতো বলে জানা গেছে।
শহিদুল ভোলার দৌলতখান উপজেলা সদরের মোহাম্মদ আলীর ছেলে। পড়াশোনার তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাবেশে দলবল নিয়ে যোগদানের ছবি ও ভিডিও রয়েছে তার। নিজেকে ওই সময় পরিচয় দিতেন নগর ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতা হিসেবে। তবে কোনো পদে ছিলেন না।
চাঁদা না পেলেই গুলি
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যে জানা গেছে, চাঁদা আদায়ে ব্যর্থ হলেই শহিদুল ও তার বাহিনীর সদস্যরা প্রকাশ্যে গুলি ছোড়েন। গত ৪ অক্টোবর তার সহযোগী মুন্না পাঁচলাইশের বাদুড়তলা এলাকায় একটি গ্যারেজের সামনে গুলি চালান। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, বিজয় চৌধুরীর গ্যারেজের সামনে গিয়ে মুন্না হুমকি দিতে থাকেন এবং একপর্যায়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি ছোড়েন। এতে কেউ আহত না হলেও, গ্যারেজের মালিক ও আশপাশের লোকজন ‘ডাকাত, ডাকাত’ বলে চিৎকার করলে মুন্না গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যান।
এর আগে গত বছরের ১০ নভেম্বর চান্দগাঁও থানার পাশের একটি মোটর গ্যারেজে চাঁদা না পেয়ে নিজেই গুলি চালান শহিদুল। গ্যারেজের মালিক মারুফ খান জানান, প্রথমে ফোনে ২০ লাখ টাকা এবং পরে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে গুলি করা হয়। একই বছরের ১৯ অক্টোবর শহিদুল ও তার সহযোগীরা মনিরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
৩০ সদস্যের বাহিনী, রয়েছে বিদেশি অস্ত্র
পুলিশ ও র্যাব জানিয়েছে, শহিদুল চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ এলাকায় ৩০ সদস্য নিয়ে একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন। এই বাহিনী এলাকায় মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।
শহিদুলের সহযোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন—১৮ মামলার আসামি আইয়ুব আলী, ৯ মামলার আসামি মো. ইদ্রিস, ৫ মামলার আসামি মো. ইয়াসিন, ৪ মামলার আসামি শিবু। এছাড়া রাকিব, সবুজ, রাসেল, ইমন, কামরুল, হাফিজুল ইসলাম, মো. মুন্না, হাবিব, মুরাদ, আজিম, শাহাব উদ্দিন, হিরু, শাকিব, বোরহান উদ্দিন, মোহাম্মদ মারুফ, আল আমিন, মিজানুর রহমান, রোকন উদ্দিন, আলী আহাম্মদ, শান্ত মজুমদার, মো. অন্তর, বিরো পাল, মোহাম্মদ রাহাত ও মোহাম্মদ ফরহাদও এই বাহিনীতে রয়েছেন।
পুলিশ সন্ত্রাসী শহিদুলের কাছে মোট কত অস্ত্র আছে তা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারেনি। তবে জানা গেছে, গত ৯ অক্টোবর বুইস্যাল তার তিন সহযোগীর কাছ থেকে ১৩টি দেশি ও বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ১৩টি ম্যাগাজিন এবং ৫৮টি গুলি উদ্ধার করেন। এর আগে গত ২০ জুলাই, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শহিদুল ও তার বাহিনীর প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে তার বেশ কয়েকজন সহযোগীর হাতে অস্ত্র দেখা যায়।
থানা থেকে লুট হওয়া গুলি ‘টর্চার সেলে’
চট্টগ্রামের চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এলাকায় একটি ভবনের তৃতীয় তলাকে শহিদুল ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করতেন। গত ২১ জুলাই সেখানে অভিযান চালিয়ে পুলিশ তার ১১ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। অভিযানে তাদের কাছ থেকে দেশি অস্ত্র, গুলি ও গুলির খোসাসহ বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, উদ্ধার হওয়া সামগ্রীর মধ্যে কিছু গুলি ও গুলির খোসা থানার কাছ থেকে লুট করা হয়েছিল।
চান্দগাঁও থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জামিনে থাকা আরেক সন্ত্রাসী ইসমাইল হোসেন ওরফে টেম্পোর বাহিনীর সঙ্গে বুইস্যার বাহিনীর গোলাগুলি হয়। এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এলাকায় সন্ত্রাসী শহিদুল ইসলামের আস্তানাটির সন্ধান পায়। সেখানে থানা থেকে লুট হওয়া দুটি গুলি ও গুলির খোসা পাওয়া গেছে। আফতাব উদ্দিন আরও বলেন, আস্তানাটিকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যাঁরা এসব সন্ত্রাসীর চাহিদামতো চাঁদা কিংবা টাকা দিতেন না, তাঁদের সেখানে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। আস্তানায় প্লায়ার্স, রামদা, সিসিটিভি ক্যামেরাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।
মেশিনে গণনা করা হতো চাঁদাবাজির টাকা
গত ১০ অক্টোবর নগরের শুলকবহর এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ শহিদুলের তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ওই এলাকায় একটি বাসার ভেতর থেকে মাদক, অস্ত্রের পাশাপাশি টাকা গণনার যন্ত্রও উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ব্যাংকে ব্যবহৃত এই যন্ত্র দিয়ে শহিদুলের বাহিনী চাঁদা ও মাদক বিক্রির অর্থ দ্রুত গণনা করত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



