জনি রায়হান : ঘটনাটি ২০১৫ সালের কোনো এক রাতের। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় দায়িত্বরত কর্মকর্তার সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন পুলিশের এক সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. আব্দুল কাদির।
এমন সময় এক নারী কাঁদতে কাঁদতে থানায় প্রবেশ করেন। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি জানান, মহাখালী এলাকা থেকে ফেরার সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তার মোবাইল ফোনটি হারিয়েছে। যে ভাবেই হোক তার মোবাইল ফোনটি যেন পুলিশ উদ্ধার করে দেয়।
শুধুমাত্র একটি মোবাইল ফোনের জন্য ওই নারীর এমন কান্না দেখে মনে কৌতূহল জাগে এএসআই কাদিরের। তিনি ওই নারীর কাছে জানতে চান-মোবাইলে কী এমন আছে, যার জন্য তিনি এত কান্না করছেন?
জবাবে ওই নারী জানান, হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটি তার বাবার শেষ স্মৃতি। তার বাবা ওই ফোনটি কিনে দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে অনেক ছবিও রয়েছে তার সেই ফোনে। কিন্তু কিছু দিন আগে তার বাবা মারা গেছেন। তাই বাবার শেষ স্মৃতিগুলো মোবাইলে বার বার দেখতেন ওই নারী। চরম মমতায় আগলিয়ে রাখতেন মোবাইল ফোনটিও। বলেই আবারও হু হু করে কান্না করতে থাকেন ওই নারী।
ওই নারীর কান্না দেখে মনে দাগ কেটে যায় এএসআই কাদিরের। তিনি মনে মনে ঠিক করেন, যেভাবেই হোক ওই নারীর মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করবেনই। নিজ উদ্দ্যোগেই যোগাযোগ করেন ডিবি পুলিশের সঙ্গে। জিডির কপিসহ অনান্য ডকুমেন্টসগুলো পাঠিয়ে দেন ডিবি কার্যালয়ে।
অবশেষে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় প্রায় তিন মাস পরে ওই নারীর মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করেন বরিশাল থেকে। হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটি হাতে পেয়ে সেদিনও খুশিতে কেঁদেছিলেন ওই নারী।
এটি মো. আব্দুল কাদিরের মোবাইল ফোন উদ্ধারের প্রথম অভিজ্ঞতা। সেই থেকেই শুরু, কখনো দায়িত্বের মধ্যে থেকে কখনোবা দায়িত্বের বাইরে গিয়েও মানুষের হারানো মোবাইল ফোন উদ্ধারের কাজ শুরু করেন তিনি। হারানো মোবাইল ফোন উদ্ধারের কাজটিকে নেশার মতো হয়ে যায় তার।
এএসআই আব্দুল কাদির বর্তমানে গুলশান থানায় কর্মরত। এখন পর্যন্ত শতশত মানুষের মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছেন। অনেক মোবাইল হারানো ভুক্তভোগীর ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিনই কেউ না কেউ ধন্যবাদ জানান তাকে। হারানো মোবাইল হাতে পেয়ে অনেকে আবেগঘন পোস্টও করেন ফেসবুকে। এভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন মোবাইল ফোন উদ্ধারের হিরো তিনি। যদিও পুলিশের অন্য বিভাগগুলোও নিয়মিত বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে হারনো বা চুরি হওয়া মোবাইল উদ্ধার করে চলছে।
শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই নয় এমন ভালো কাজে স্বীকৃতী তিনি পেয়েছেন পুলিশ বিভাগ থেকেও। চলতি বছরের নভেম্বর মাসের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন এএসআই আব্দুল কাদির।
মোবাইল ফেরত পাওয়া ব্যক্তিদের ভাষ্য
শত শত মানুষের মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছেন এএসআই আব্দুল কাদির। হারানো ফোন ফিরে পেয়ে ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে সাধারণ মানুষের।
রিয়াদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘চলতি বছরের ৬ জুন আমার শখের মোবাইল ফোনটি হারিয়ে যায়। ফোন হারিয়ে গেলে কেমন লাগে তা কমবেশি সকলেরই জানা। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে সৌভাগ্যক্রমে এএসআই আব্দুল কাদের স্যারের সন্ধান পাই। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গত ১২ সেপ্টেম্বরে আমার মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হয়েছে।’
রাকিবুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ‘ভাবতে পারিনি যে দীর্ঘ ১০ মাস পরে আমার হারানো ফোনটি ফিরে পাবো। এএসআই আব্দুল কাদির এবং পুরো পুলিশকে ধন্যবাদ। পুলিশের কাজের প্রতি বিশ্বাস বহুগুন বেড়েছে আমার।’
মো. রফিকুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘পুলিশ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। পরপর ২টা মোবাইল ফোন হারিয়ে আমি প্রায় বিধস্ত। তখনই একজনের মাধ্যমে খোঁজ মেলে এএসআই আব্দুল কাদির ভাইয়ের। তার চেষ্টায় এক মাস পরে আমার মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হয়।’
যা বললেন কাদিরের সহকর্মীরা
এএসআই আব্দুল কাদিরের বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এএসআই আব্দুল কাদির আন্তরিকতার সহিত মোবাইল উদ্ধারের কাজগুলো করে। আমরা অফিসিয়ালি তাকে সকল ধরনের সহায়তা করে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত মোবাইল হারিয়ে গেলে থানায় যে জিডি, মামলা বা অভিযোগগুলো হয় তার ভিত্তিতে কাদির বিভিন্ন কৌশলে মোবাইল ফোনগুলো উদ্ধারের কাজ করে।’
গুলশান থানার আরেক উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. জিয়াউদিন বলেন, ‘কাদির খুবই মনোযোগের সাথে মোবাইল উদ্ধারের কাজগুলো করে৷ সহকর্মী হিসেবে নানা সময়ে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করে এসআই কাদির।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়াও অনেক মামলা তদন্তের জন্য কাদিরের সহায়তা আমরা নিয়ে থাকি। কাদিরও সরলভাবেই আমাদের সহায়তা করে সবসময়ই।’
যা বললেন কাদির
গুলশান থানার এএসআই আব্দুল কাদির বলেন, ‘আমি ৭ আগস্ট ২০০৫ সালে পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে যোগদান করেছিলাম। ২০১৩ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) যোগদান করি। এরপর ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে এএসআই হয়ে তেজগাঁও শিল্পাঅঞ্চল থানায় কাজ করেছি। বর্তমানে গুলশান থানায় কর্মরত রয়েছি।’
মোবাইল উদ্ধারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত দুই শতাধিক বা তারও বেশি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নিকট হস্তান্তর করেছি। আর এ ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মাননীয় পুলিশ কমিশনার স্যারের নিকট থেকে একাধারে আটবার পুরস্কার পেয়েছি এবং গত ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশে বাহিনীর সর্বোচ্চ দ্বিতীয় পুরস্কার আইজিপি ব্যাচ পদকও পেয়েছি।’
এ কাজে সহকর্মীদের কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন জানতে চাইলে কাদির জানান, সব সময় সহযোগিতা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার এই কাজে আমাকে সহযোগিতা করেছেন ইন্সপেক্টর অপারেশন শেখ শাহানুর স্যার, আর যে আমাকে সব সময় দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ দিয়ে পাশে থেকে কাজের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন তিনি হলেন ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম স্যার। এ ছাড়া সততার সঙ্গে কাজ করার জন্য পরামর্শ দিতেন গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান স্যার।’
‘আর যিনি আমাকে বার বার পুরস্কৃত করে কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য উৎসহ প্রদান করেছেন এবং মানুষের বিপদে কীভাবে পুলিশি সেবা দিতে হয় অসহায় মানুষকে কীভাবে সেবা দিতে হয় সেই শিক্ষা দিয়েছেন তিনি হলেন আমাদের পুলিশ বাহিনীর গর্ব এবং মানবিক একজন পুলিশ অফিসার গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী স্যার’, যোগ করেন তিনি।
এএসআই কাদির আরও বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে ভালো কাজ করলে মানুষের সম্মান এবং মানুষের দোয়া সব কিছুই পাওয়া যায়। পুলিশ মানুষের বন্ধু এবং জনগণের সেবক এই কথাগুলো এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। বাংলাদেশ পুলিশ এখন জনগণকে সেবা দিতে জনগণের দরজায় হাজির থাকে।’ সূত্র : দৈনিক আমাদের সময় অনলাইন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।