জুমবাংলা ডেস্ক : যশোরের শার্শায় চোরাকারবারীর পথ ছেড়ে দেশের স্বার্থে সোনালী মাঠে সবজি চাষে ব্যস্ত তারা। বয়স ১৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। ভারতে যেতেন রাতের আঁধারে, চোরাই পথে। জীবনবাজি রেখে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে গরু আনতেন।
বিএসএফের গুলি উপেক্ষা করে এ কাজ করতেন তারা। শুধু সীমান্ত পার করে দেয়ার বিনিময়ে গরুপ্রতি পেতেন দুই থেকে চার হাজার টাকা। জীবনের ঝুঁকি থাকে বিধায় মজুরি এত বেশি! ১৮ বছর বয়সী এক যুবক মাসে তিনবার ভারতে গিয়ে ছয়টি গরু আনতে পারলে আয় কমপক্ষে ১২ হাজার টাকা। ক্ষেত্রবিশেষ আয়ের পরিমাণ আরও বেশি।
১৫ দিন ভারতে গিয়ে ৩০টি গরু সীমান্ত পার করতে পারলে আয় অন্তত ৬০ হাজার টাকা। স্বল্প শিক্ষিত কোনো মানুষের পক্ষে অল্প পরিশ্রমে এত বেশি টাকা আয়ের সুযোগ নেই অন্য কোনো পেশায়। টাকার লোভে যুবকরা সীমান্তের ওপারে যান, খান বিএসএফের গুলি!
স¤প্রতি সীমান্ত এলাকায় যেন বইছে দিন পরিবর্তনের হাওয়া। একসময় যারা গরু চোরাকারবারি ছিলেন, তারাই এখন ঝুঁকে পড়েছেন ক্ষেতের সবুজ মাঠে। একদিকে বিএসএফের গুলি অন্যদিকে মাদক মামলা থেকে বাঁচতে যশোরের শার্শা উপজেলার সীমান্তঘেঁষা গোগা ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রামে চোরাচালান কারবার ছেড়ে সবজি চাষে ঝুঁকেছেন অনেকে। গ্রামটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। তারা ভারতীয় গরু আনার কাজসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
স্থানীয় কয়েকজন চোরাকারবারি জানান, একদিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলি, অন্যদিকে বিজিবি সদস্যদের মিথ্যা মামলা; পাচারকারীদের ধরে ধরে ফেনসিডিল দিয়ে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেয় বিজিবি। এই দুই কারণে গ্রামবাসীর অনেকেই এখন তাদের চোরাচালান পেশা ছেড়ে ফিরে এসেছে সোনালী মাঠের সবজি চাষে।
সবজি চাষ করে এখন তারা স্বাবলম্বী এবং সুস্থ জীবনযাপন করছেন। বদলে নিয়েছেন তাদের জীবনের পাশাপাশি পরিবারের জীবনও। সীমান্তের ২০০ গজের মধ্যে পাটসহ কোনো উঁচু গাছ বা ফসল লাগানো নিষেধ রয়েছে বিজিবির পক্ষ থেকে। তাই গ্রামের লোকজন সীমান্তের ধারঘেঁষে এখন পটল, উচ্ছে, বেগুন, কাঁচা মরিচসহ নানা ধরনের সবজির চাষ করছেন। তবে পটল চাষে মানুষের আগ্রহ বেশি।
পটল চাষি রেজাউল জানান, তিনি ১২ কাঠা জমিতে পটল, নালার ধার ঘেঁষে পেঁয়াজ ও রসুন চাষ করেছেন। আর জমির আইলের ধারে বাঁধাকপি লাগিয়েছেন। এই বছর প্রথম তিনি ৯০ টাকা কেজি দরে পটল বিক্রি করেছেন। পটল চাষে তার খরচ খুব একটা বেশি হয়নি। গত বছর এই জমিতে তিনি প্রায় এক লাখ টাকার পটল বিক্রি করেছিলেন।
রুদ্রপুর বিজিবি ক্যাম্পের পূর্বপাশ থেকে খালমুখ পর্যন্ত সীমান্ত সংলগ্ন সারা মাঠেই পটলের চাষ। ক্যাম্পের পশ্চিম পাশের সীমান্তসংলগ্ন সব জমিতে একই কায়দায় পটলের চাষ চলছে। ফলে চোরাচালান ও গরুটানা কাজে আর কেউ যেতে চাইছেন না। তাদের জীবন কাটছে এখন সুন্দরভাবে।
স্থানীয় সাংবাদিক আজিজুল ইসলাম জানান, মূলত দারিদ্র্য ও বেকারত্বের কারণে সীমান্ত এলাকার যুবকরা গরু চোরাচালানের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। এ উপার্জনের দিকে তাকাতে গিয়ে প্রাণকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতেও পিছপা হননি গরু পাচারকারীদল। এ পেশাকে তারা চোরাচালান নয় ব্যবসা হিসেবে দেখেছেন। চোরাচালান করতে গিয়ে প্রায়শই বিএসএফের হাতে তাদের প্রাণ দিতে হচ্ছিল অথবা হতে হচ্ছিল অমানুষিক নির্যাতনের শিকার।
‘এখন আর তারা গরু আনতে ভারত সীমান্তে যাচ্ছেন না। নিজের জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতে পরিশ্রম করে চোরাচালানির চেয়ে বেশি টাকা আয় করছেন। পাশাপাশি পরিবারকে দুশ্চিন্তামুক্ত করেছেন।’
এ বিষয়ে কায়বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসান ফিরোজ টিংকু জানান, সীমান্তে চোরাচালান ও গরু পাচার বন্ধে বিজিবির পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সীমান্তের মানুষকে সভার মাধ্যমে সচেতন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এখন আর কেউ গরু আনতে ভারত সীমান্তে যাচ্ছেন না। ফলে সীমান্তে গোলাগুলিও নেই। যারা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত তাদের অধিকাংশই এখন মাঠে কাজ করছেন। সবজিসহ বিভিন্ন চাষাবাদে মনোযোগী হয়েছেন। তবে এদের চাষাবাদে সরকারের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি হত্যার সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও বিষয়টি ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে বলা হয়েছে, এসব কেন হচ্ছে?
গত ২৩ জানুয়ারি নওগাঁর পোরশার হাঁপানিয়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে তিন বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নিহত হন। এর আগের দিন ২২ জানুয়ারি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সীমান্তে দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। গত ৮ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওয়াহেদপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন দুই বাংলাদেশি যুবক। আহত হন আরও দুজন। মূলত ভারত থেকে গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের বন্দুকের মুখে পড়েন তারা।
গত ২ জানুয়ারি বিজিবি সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালে সীমান্ত হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৫ বাংলাদেশি। পরিসংখ্যান অনুসারে, গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকান্ড ঘটেছে ২০১৯ সালে। ২০১৬ সালে ২৫, ২০১৭ সালে ১৭ ও ২০১৮ সালে ৩ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান।
শার্শা উপজেলার সীমান্তঘেঁষা কায়বা ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রামের চোরাকারবারিদের সবজি চাষে ঝুঁকে পড়ার খবর দেশের অপর সীমান্ত এলাকার চোরাকারবারিদের মধ্যে নতুন করে বেঁচে থাকার আশার সঞ্চার করবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।