প্রবাস ডেস্ক: বিনম্র শ্রদ্ধা, যথাযথ মর্যাদা ও পূর্ণ ভাবগাম্ভীর্যে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে জর্ডানে পালিত হয়েছে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
রবিবার জর্ডানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২১ উপলক্ষে দিনব্যাপী তিনটি পর্যায়ে দুইটিআলোচনা সভা ও একটি ভার্চুয়াল কনসার্টের আয়োজন করা হয়।
দিবসের প্রত্যূষে এই উপলক্ষে দূতাবাসে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও দূতাবাসে স্থাপিত শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে ভাষা শহিদদের স্মরনে দাড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। দূতাবাস নির্মিত একটি ছোট ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
একুশের আলপনায় সজ্জিত দূতাবাস চত্বরে এসময় মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত সহ কূটনীতিক বৃন্দ, বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, জর্ডানের স্থানীয় নাগরিক এবং জর্ডানে বসবাসরত বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক পর্যায়ে একুশের `আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি বাংলা ও আরবী ভাষায় পরিবেশন করা হয়।
জর্ডানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কোভিড মহামারির কারণে বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও জর্ডান, বাংলাদেশ ও পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্ত থেকে যুক্ত হওয়া সকল সন্মানিত অতিথি ও দর্শকবৃন্দকে অনুষ্ঠানে স্বাগত জানান।
তিনি বলেন, `বঙ্গবন্ধুর কারণে আজ বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব বাঙ্গালির জাতীয় চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব একটি স্বাধীন জাতির ভিত রচনা করেছিল যা কয়েক দশকের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।’
ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জর্ডানের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী ড. বাসেম মোহাম্মদ আল তুয়েসি, বিশেষ অতিথি হিসেবে ঢাকা থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হন বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জনাব কে এম খালিদ।
এছাড়া বিশেষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর আব্দেল করিম এবং ঢাকা থেকে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদ।
দিবসটি উপলক্ষ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ও মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বানী পাঠ করা হয় এবং মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রদত্ত ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জর্ডানের সংস্কৃতি মন্ত্রী ড. বাসেম মোহাম্মদ আল তুয়েসি বলেন, `মাতৃভাষা বাঙ্গালীর ভাষার জন্য আত্মত্যাগ শুধু মাত্র তাদের নিজদের ভাষাই নয় বরং সে সাথে বিশ্বের প্রতিটি ক্ষুদ্র ও আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের ভাষা শহিদ দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, `ভাষা বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং এটি মানুষের অতীত, ঐতিহ্য এবং ভবিষ্যতের সাথে সেতু বন্ধন। এটি যোগাযোগের মৌলিক মাধ্যম। ভাষা একটি জাতীর পরিচয় বহন করে। তাই বিশ্ব যত বেশি বহুভাষাভাষী সংখ্যা বজায় রাখতে পারবে ততই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হবে।’
ড. বাসেম মোহাম্মদ আল তুয়েসি বাংলাদেশ ও জর্ডানের পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধির লক্ষ্যে উভয় ভাষার শিল্প ও সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য রচনা সমূহ ও উভয় ভাষায় অনুবাদ করার উপর গুরুত্ব দেন। তিনি এই দিবসকে আন্তর্জাতিকীকরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর ভিডিও বার্তায় বলেন, `বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে প্রথমবারের মত বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের অন্যান্য ভাষাভাষীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেন।
তিনি অমর একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে বাংলাদেশকে একটি প্রগতিশীল, প্রযুক্তি নির্ভর, উন্নত ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, `ভাষা একটি জাতির পরিচয়। এটি জাতিসত্তার ধারক ও বাহক। আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা নিজেদের মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এবং সেই ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশের ক্ষমতা গ্রহনের পরপরই বাংলাদেশের প্রথম গৃহীত সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণটিও ছিল বাংলায় দেয়া। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে থাকেন।’
বিশেষ অতিথি বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জনাব কে এম খালিদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, `বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তৎকালীন অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে সংগঠিত আন্দোলনে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী প্রাণ দিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। ভাষার দাবীতে প্রান বিসর্জন দেয়া পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।’
তিনি আরও বলেন, `এ দিবসের তাৎপর্য লুকিয়ে আছে দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে, দেশের সংস্কৃতিকে ভালোবাসা ও তার জন্য গর্ববোধ করার মধ্যে। এ দিবসে প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালবাসবে তেমনি অন্য জাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে। এভাবে একুশকে চেতনায় ধারন করে মাতৃভাষাকে ভালোবাসার প্রেরনা পাবে মানুষ।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ বক্তা জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর আব্দেল করিম তাঁর বক্তব্যে বলেন, `আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এই আরব অঞ্চলের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ । ভাষা আন্দোলনে শহীদ বাঙালি ভাইদের প্রতি আমার সালাম ও শ্রদ্ধা, তাঁদের আত্মত্যাগের বিনময়ে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পৃথিবীর সকল মাতৃভাষার অধিকার।’
তিনি আরও বলেন, `বাংলাদেশ ও জর্ডান তাঁদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে ভাষান্তরের মাধ্যমে আরও কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। দূতাবাসের উদ্যেগে এই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য তিনি মান্যবর রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।’
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদ `ভাষার অধিকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
তাঁর উপস্থাপনায় তিনি চল্লিশের দশকের শেষভাগ এবং পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কেন্দ্রীয় ভূমিকা তুলে ধরেন। এছাড়া মাতৃভাষার সংগ্রাম কীভাবে জাতির পিতার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করেছিল সেই বিষয়ে আলোকপাত করেন।
তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় যেভাবে ২১ ফেব্রুয়ারী ইউনেস্কো দ্বারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে এবং প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার বাংলাদেশের জাতিগত সংখ্যালঘু ভাষার মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহন করছেন তা তুলে ধরেন।
শাহ আলী ফরহাদ বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় চেতনার জন্মদান এবং বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সপ্নকে বাস্তবায়িত করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের যে নিরন্তর অগ্রগন্যতা তার উপর আলোকপাত করেন।
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে ভার্চুয়াল মাধ্যমে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ, ভারত, জর্ডান ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শিল্পিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া বাংলাদেশের কবি মুজতবা আহমেদ মোরশেদ এবং জর্ডানদের সারকাসিয়ান ভাষার কবি আহমদে হামজুক স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আরও যোগদান করে জর্ডানস্থ ভারতীয় দূতাবাস ও মেক্সিকান দুতাবাস। অনুষ্ঠানে জর্ডানের জাতীয় সঙ্গিত কনজারভেটরি,বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং প্রবাসী বাংলাদেশি শিশু কিশোরদের অংশগ্রহণে একুশের গান পরিবেশন করা হয়।
অনুষ্ঠানের শেষে সকলের অংশগ্রহণে একটি আরবি গানও পরিবেশন করা হয়।একই দিনে তৃতীয় পর্যায়ে জর্ডানস্থ প্রবাসী বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণেও একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানের শুরুতে শহীদ মিনারে বাংলাদেশীরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
জর্ডানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এই ওয়েবিনারটি দূতাবাসের “মুজিব বর্ষ ওয়েবিনার সিরিজের ৪র্থ ওয়েবিনার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।