(বাতিলের বেদনা, নতুনের আশা — এই দ্বন্দ্বের মাঝেই পা বাড়ান রিনা আক্তার। ঢাকার মিরপুরে ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসে সদ্য পাওয়া ডিভোর্স ডিক্রির কাগজটা হাতে নিয়ে তার চোখে ভেসে উঠল দুটি মুখ: একদিকে ৮ বছরের ছেলে আরিফের হাসি, অন্যদিকে বিচ্ছেদের কাঠখোট্টা বাস্তবতা। “এখন কী হবে?” — এই প্রশ্নটাই যেন ঘুরপাক খাচ্ছে মনের ভেতর। তার মতো হাজারো বাংলাদেশী নারী-পুরুষের জন্য ডিভোর্স পরবর্তী লাইফ ম্যানেজমেন্ট শুধু টিকে থাকার কৌশল নয়, আত্মশক্তির পুনরাবিষ্কার।)
ডিভোর্স পরবর্তী লাইফ ম্যানেজমেন্ট: কেন এত জরুরি?
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, দেশে ডিভোর্সের হার গত পাঁচ বছরে ২২% বেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদের মতে, “বিচ্ছেদের পর প্রথম ৬ মাসই সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল। এ সময় মানসিক ধস, আর্থিক অনিশ্চয়তা আর সামাজিক চাপ একসাথে আঘাত হানে। সঠিক ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানই পারে ভবিষ্যৎকে আলোকিত করতে।”
মানসিক ভাঙন মোকাবেলায় তিন স্তরবিশিষ্ট পদ্ধতি:
১. তাৎক্ষণিক সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি:
- ঢাকার সাইকোথেরাপিস্ট ড. ফারহানা রহমানের পরামর্শ: “প্রতিদিন ১০ মিনিট ‘ইমোশনাল ডাম্পিং’ করুন। ডায়েরিতে লিখুন বা বিশ্বস্ত বন্ধুকে ফোন করুন। চাপা রাখলে তা শারীরিক অসুস্থতা ডেকে আনে।”
- আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (ASK) হেল্পলাইন (০১৭৬৬-৮৬৬৮৮৬) ২৪/৭ সাইকোলজিকাল ফার্স্ট এইড দেয়।
২. দীর্ঘমেয়াদি রিকভারি প্ল্যান:
| সময়সীমা | করণীয় | লক্ষ্য |
|----------------|-------------------------------|----------------------------|
| ১-৩ মাস | থেরাপি নেওয়া, রুটিন তৈরি | স্থিতিশীলতা ফিরে পাওয়া |
| ৪-৬ মাস | নতুন দক্ষতা শেখা, আয় বৃদ্ধি | আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা |
| ৭-১২ মাস | সামাজিক সংযোগ বাড়ানো | পরিচয় পুনর্গঠন |
৩. ট্রিগার ম্যানেজমেন্ট:
- বিবাহবিচ্ছেদের পর জন্মদিন বা ঈদে বিষণ্ণতা বাড়ে। ঢাকার সাইকিয়াট্রিস্ট ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের পরামর্শ: “এই দিনগুলোকে ‘নিউ ট্র্যাডিশন’ দিন। যেমন: সন্তান নিয়ে নতুন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া।”
আর্থিক স্বাধীনতা: ভবিষ্যতের ভিত্তিপ্রস্তর
বাস্তব উদাহরণ: খুলনার মৌসুমী আক্তার (৩৮)। ডিভোর্সের পর স্বামীর দেওয়া ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন হোম-বেকিং বিজনেস। আজ তার ‘মোমোর বেকারি’তে ৪ জন কর্মী। তার সাফল্যের সূত্র:
- জরুরি তহবিল: প্রথম ৬ মাসের খরচ আলাদা করে রাখা
- স্কিল ডেভেলপমেন্ট: বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্সের (BWCCI) ফ্রি কোর্সে অংশ নেওয়া
- আইনি অধিকার সচেতনতা: পারিবারিক আদালত থেকে পাওনা ভাতা আদায় (বাংলাদেশ নারী আইন সহায়তা সংস্থা)
আর্থিক প্ল্যানিংয়ের চেকলিস্ট:
- সম্পত্তি বিভাজন নথিভুক্ত করা (রেজিস্ট্রার অফিসে)
- সন্তানের ভরণপোষণের আদেশ কার্যকর করা
- জীবন বীমা নমিনি পরিবর্তন
- ক্রেডিট কার্ড/লোনে যৌথ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা
সন্তানের লালন-পালন: দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার ভারসাম্য
ঢাকা ফ্যামিলি কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সারা হোসেনের ব্যাখ্যা: “অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে আদালতের মূল বিবেচনা সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ। মায়ের একক অধিকার ধারণাটি ভুল।”
সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার উপায়:
- বাস্তবতা বলুন, কিন্তু দোষারোপ নয়: “আমাদের আলাদা থাকাই ভালো” — এটা শিশুবান্ধব ভাষা
- প্যারেন্টিং প্ল্যান তৈরি: জন্মদিন, স্কুল মিটিং ভাগ করে নিন
- পরামর্শ নিন: শিশু বিকাশ কেন্দ্রের (CDC) কাউন্সেলিং সেশন (প্রতি সেশনে ৫০০ টাকা)
সামাজিক চ্যালেঞ্জ: কুসংস্কার ভাঙার যুদ্ধ
ডিভোর্সি মেয়েকে বাড়ি ভাড়া দেব না” — রাজশাহীর নাসরিন আক্তারের (৩২) মুখে শোনা এই বাক্য বাংলাদেশের অনেক নারীর প্রতিদিনের লড়াই। সামাজিক ট্যাবু ভাঙতে:
- নেটওয়ার্কিং: ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হন (৫০,০০০+ সদস্য)
- ক্যারিয়ার ফোকাস: রিক্রুটাররা এখন ডিভোর্সকে ‘লাইফ এক্সপেরিয়েন্স’ হিসেবে দেখেন
- সামাজিক ইভেন্টে যাওয়া: একা যেতে ভয় পেলে নারীপক্ষের ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন
আত্ম-উন্নয়ন: ভাঙা হৃদয় থেকে উত্থানের কাহিনী
চট্টগ্রামের আরিফুল ইসলাম (৪৫) ডিভোর্সের পর পেয়েছিলেন সাংঘাতিক ডিপ্রেশন। তার টার্নিং পয়েন্ট:
- ফিজিকাল অ্যাক্টিভিটি: প্রতিদিন সকালে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে হাঁটা
- হবি ক্লাব: স্থানীয় ফটোগ্রাফি গ্রুপে যোগ দেওয়া
- ভলান্টিয়ারিং: রোটারাক্ট ক্লাবে মানসিক স্বাস্থ্য ক্যাম্পেইন
নিজেকে পুনরাবিষ্কারের স্টেপ-বাই-স্টেপ গাইড:
১. অভ্যাসের পুনর্বিন্যাস: প্রতিদিন ১টি ইতিবাচক কাজ (গান শোনা, গাছ রোপণ)
২. ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন: “আমি কে?” লিস্ট তৈরি করুন (দায়িত্ব, আবেগ, দক্ষতা আলাদাভাবে)
৩. দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য: ৫ বছরের ভিশন বোর্ড তৈরি
ডিজিটাল লাইফ ম্যানেজমেন্ট: প্রোফাইল রিব্র্যান্ডিং
- সোশ্যাল মিডিয়া ক্লিনআপ: পুরনো জয়েন্ট ছবি আর্কাইভ করুন
- প্রফেশনাল প্রোফাইল আপডেট: লিঙ্কডইনে “সিঙ্গেল পেরেন্ট” হিসেবে আইডেন্টিটি যোগ করুন
- অনলাইন থেরাপি: মনোযোগ অ্যাপ (Monojoj) এর বাংলা কাউন্সেলিং সেশন
জেনে রাখুন (FAQs):
প্রশ্ন: ডিভোর্সের পর সন্তানের অভিভাবকত্ব কীভাবে নির্ধারিত হয়?
উত্তর: বাংলাদেশে গার্ডিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০ অনুযায়ী আদালত সন্তানের কল্যাণ, বয়স, পিতামাতার আর্থিক সামর্থ্য ও নৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে। সাধারণত ৭ বছরের কম বয়সী শিশু মায়ের কাছে যায়। বিস্তারিত জানতে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ওয়েবসাইট দেখুন।
প্রশ্ন: মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে কোথায় সাহায্য পাব?
উত্তর: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (০২-৯১৩১৯৪৫), মনোযোগ হেল্পলাইন (১৬৬৪৩), বা আপনার জেলার সিভিল সার্জন অফিসে বিনামূল্যে কাউন্সেলিং সেবা আছে। প্রাইভেট থেরাপিস্ট খুঁজতে বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটির ডিরেক্টরি ব্যবহার করুন।
প্রশ্ন: ডিভোর্সের পর সম্পত্তি বিভাজনের নিয়ম কী?
উত্তর: মুসলিম পারিবারিক আইনে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তিতে সরাসরি অধিকার পান না, তবে দেনমোহর ও ভরণপোষণ পাবার আইনি অধিকার আছে। হিন্দু ও খ্রিস্টান আইনে আলাদা বিধান। নিশ্চিত হতে লিগ্যাল এইড কমিটি বা জেলা আইনজীবী সমিতির পরামর্শ নিন।
প্রশ্ন: নতুন করে সম্পর্কে জড়ানোর আগে কী বিবেচনা করব?
উত্তর: প্রথমে নিজের আবেগগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করুন (কমপক্ষে ১ বছর)। নতুন সম্পর্কে সন্তানের প্রস্তুতি, আর্থিক স্বচ্ছতা, এবং মূল্যবোধের সামঞ্জস্য যাচাই করুন। রিলেশনশিপ কাউন্সেলর ড. ফাহমিদা হকের মতে, “অসম্পূর্ণ আবেগ নিয়ে নতুন সম্পর্ক বিষাক্ত হয়।”
ডিভোর্স পরবর্তী লাইফ ম্যানেজমেন্ট কোনো গন্তব্য নয়, পথচলার কৌশল। রিনা আজ তার ডায়েরিতে লিখেছে: “একা হওয়া মানে অসহায় হওয়া নয়। এই নদীর স্রোত আমিই ঠিক করব কোন পথে বইবে।” আপনার ভাঙনের গল্পই হতে পারে শক্তির নতুন ভাষা। আজই শুরু করুন: একটি ছোট লক্ষ্য ঠিক করুন, একজন বিশ্বস্ত মানুষকে জানান, আর নিজেকে বলুন — “আমি পারব।” মনোবিদ ড. আলমগীর কবীরের শব্দে: “বিচ্ছেদ শেষ কথা বলে না, বলার নতুন সুর খোঁজে।” নিজের সেই সুরটিকেই আজ ডাক দিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।