স্পোর্টস ডেস্ক: ভারতের সাবেক টেস্ট ওপেনার ওয়াসিম জাফর উত্তরাখন্ড রাজ্যের কোচ হিসেবে মুসলিম ক্রিকেটারদের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন কিংবা ড্রেসিংরুমে মৌলভি ডেকে এনেছেন- এই ধরনের অভিযোগ ওঠার পর ভারতীয় ক্রিকেটে এক নজিরবিহীন বিতর্ক শুরু হয়েছে। খবর বিবিসি বাংলার।
ওয়াসিম জাফর নিজে যদিও তার বিরুদ্ধে ওঠা ধর্মীয় পক্ষপাতের প্রতিটি অভিযোগ ধরে ধরে খন্ডন করেছেন, ভারতীয় ক্রিকেটের বড় বড় নামগুলো কেউই এখনও তার সমর্থনে বিশেষ এগিয়ে আসেননি।
এদিকে এই বিতর্কের পটভূমিতে দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের দলনেতা রাহুল গান্ধী ক্রিকেট থেকে অন্তত ধর্মীয় বিদ্বেষ দূরে রাখার ডাক দিয়েছেন- তবে তিনিও ওয়াসিম জাফরের নাম করেননি।
গোটা বিষয়টিকে ভারতীয় ক্রিকেটের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের ওপর বিশাল আঘাত বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
প্রায় এক দশকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ওয়াসিম জাফর ভারতের হয়ে ৩১টি টেস্ট খেলেছেন, একটি ডাবল-সহ করেছেন পাঁচটি সেঞ্চুরিও।
তবে মুম্বাইয়ের এই তারকাকে ভারত মনে রেখেছে ঘরোয়া ক্রিকেটের বাদশাহ হিসেবেই- কারণ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার কুড়ি হাজারের কাছাকাছি রান এখনও ভারতে রেকর্ড।
সম্প্রতি উত্তরাখন্ড রাজ্যের প্রধান ক্রিকেট কোচ হিসেবে সরে দাঁড়ান জাফর- আর তারপরই ওই রাজ্যের ক্রিকেট কর্মকর্তারা ‘জাগরণ’ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন কোচ হিসেবে তিনি নাকি দলে মুসলিমদের প্রতি পক্ষপাত দেখাতেন।
উত্তরাখন্ড ক্রিকেট সংস্থার সচিব মাহিম ভার্মা সেখানে বলেন, জাফর টিম ড্রেসিংরুমে নামাজ পড়ার জন্য মৌলভিও ডেকে এনেছিলেন এবং দল নির্বাচনেও মুসলিম ক্রিকেটারদেরই প্রাধান্য দিতেন।
পরদিনই এক অনলাইন প্রেস কনফারেন্সে এর প্রতিটি অভিযোগ খন্ডন করেন জাফর নিজে- কিন্তু ততক্ষণে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারতীয় ক্রিকেটে এক বিরল ধর্মীয় বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে।
উত্তরাখন্ড ক্রিকেট সংস্থার অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা দিব্যা নৌটিয়াল অবশ্য বলছিলেন, আসলে জাফরের পছন্দ মতো টিম বানানো হচ্ছিল না, তার পছন্দের খেলোয়াড়দের নেওয়াও হচ্ছিল না। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি টেন্ডুলকারের চেয়েও বড় মাপের প্লেয়ার, অথচ তার সেই সাফল্যকে আমাদের রাজ্যই কাজে লাগাতে পারেনি।
তিনি বলেন, ধর্মীয় পক্ষপাতের অভিযোগ সম্পূর্ণ বাজে কথা, দেশের হয়ে খেলা এত বড় ক্রিকেটার কখনও এ জিনিস করতেই পারেন না। কত শুক্রবারই তো আমাদের ম্যাচ পড়েছে, জাফর কি কখনও ম্যাচ ফেলে নামাজ পড়তে গেছেন নাকি?
ওয়াসিম জাফর নিজেও টুইটারে দাবি করেছেন, ড্রেসিংরুমে তিনি কখনও কোনও মৌলভিকে আমন্ত্রণ জানাননি।
উত্তরাখন্ড টিম এর আগে শিখদের একটি ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে টিম হাডল করত- তিনি সেই জায়গায় শুধু ‘গো উত্তরাখন্ড’ বলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলেও জানিয়েছেন।
তিনি এই আত্মপক্ষ সমর্থন করার তিনদিন বাদে ভারতের বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী একটি টুইটে লেখেন, ধর্মীয় বিদ্বেষ এখন আমাদের প্রিয় খেলা ক্রিকেটকেও ছেড়ে কথা বলছে না, দয়া করে দেশের ঐক্য ভাঙতে দেবেন না।
জাফরের টিমমেট মোহাম্মাদ কাইফ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখে আবেদন জানান, প্লিজ ক্রিকেটকে অন্তত দূষিত করবেন না।
তবে কলকাতার ক্রিকেট ভাষ্যকার প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত বলছিলেন, ভারতীয় ক্রিকেটের রথী-মহারথীরা যে এখনও প্রকাশ্যে জাফরের সমর্থনে এগিয়ে আসেননি, সেটাই আক্ষেপের।
তিনি বলছিলেন, মাত্র কদিন আগেই ভারতীয় ক্রিকেটের বড় বড় নামগুলো কৃষক আন্দোলন নিয়ে পাখি পড়ার মতো এক সুরে প্রায় একই কথা টুইট করে গেলেন- আর সেটাও অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে। অথচ ওয়াসিম জাফর ইস্যুতে তারা প্রায় প্রত্যেকেই আশ্চর্যজনকভাবে নীরব, একজন ক্রিকেট সাংবাদিক হিসেবে আমার সেটা ভেবেই সবচেয়ে খারাপ লাগছে।
তিনি আরও বলেন, আমি গুনে দেখেছি ভারতের মাত্র ছজন ক্রিকেটার এখনও পর্যন্ত জাফরের সমর্থনে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন বা টুইট করেছেন- যার মধ্যে সবচেয়ে বড় নাম অনিল কুম্বলে। এছাড়া মোহাম্মাদ কাইফ একটা আর্টিকল লিখেছেন, টুইট করেছেন মনোজ তিওয়ারি, শিশির হাত্তাঙ্গাডি, চন্দ্রকান্ত পন্ডিত আর ডোডা গণেশ। কিন্তু এর বাইরে আর কোনও বড় নাম সে তালিকায় নেই। অথচ জাফরের টিমমেট সৌরভ গাঙ্গুলি নিজেই এখন বিসিসিআইয়ের সভাপতি … তারা কেউই এখনও কিছু বললেন না।
প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত বলেন, একজন ক্রিকেট কর্মকর্তার বক্তব্যকেই এখানে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে আমার ধারণা- কিন্তু তারকা ক্রিকেটাররা ব্যক্তিগতভাবে যা-ই ভেবে থাকুন তারা কিন্তু বিষয়টা নিয়ে মুখ খুলছেন না।
ভারতের ক্রিকেটে দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন মনসুর আলি খান পাতৌদি বা মহম্মদ আজহারউদ্দিন, বোলিং ওপেন করেছেন জাহির খান বা মোহাম্মাদ শামি।
সেই জাতীয় দলে খেলা ওয়াসিম জাফরকে নিয়ে এ ধরনের বিতর্ক ভারতীয় ক্রিকেটের জন্যই আসলে চরম দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করছেন মিস রক্ষিত।
তিনি বলছিলেন, ভারতের জার্সি পরে যখন এগারোজন মাঠে নামেন তখন তারা প্রত্যেকেই কিন্তু ভারতীয়- তারা কেউ আলাদাভাবে হিন্দু, মুসলিম, জৈন বা খ্রিষ্টান নন এটাই এতদিন আমরা জেনে এসেছি। এই তো সেদিন মোহাম্মাদ সিরাজের বিরুদ্ধে যখন অস্ট্রেলিয়ায় স্লেজিং আর বর্ণবাদী আক্রমণ হল, গোটা টিম তার পেছনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল।
তিনি বলেন, একজন ভারতীয় ক্রিকেটার যখন মাঠে নামছে বা রিজার্ভ বেঞ্চও বসছে, তার নির্বাচনের পেছনেও কখনও ধর্ম প্রভাব ফেলেনি।
প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত বলেন, সে কোন রাজ্য থেকে আসছে, সেই আঞ্চলিকতার ফ্যাক্টর হয়তো ছিল বা এখনও আছে – কিন্তু ধর্ম কখনও ফ্যাক্টর ছিল না বলেই আজ ওয়াসিম জাফর ইস্যুটা এতটা আঘাত করছে।
গতকাল ভারত-ইংল্যান্ড টেস্টের প্রথম দিনের শেষে ওয়াসিম জাফর বিতর্ক নিয়ে প্রশ্নের মুখে ভারতের ভাইস ক্যাপ্টেন আজিঙ্কা রাহানে “এ বিষয়ে কিছুই জানা নেই” বলে প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
আর জাফর নিজে রবিবার সকালে টুইট করেছেন দুবছর আগে কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে জঙ্গী হামলায় নিহত চল্লিশজন ভারতীয় জওয়ানের ছবি, তিনি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ‘দেশের নায়কদের’।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।