বেগম মতিয়া চৌধুরী: আগস্ট মাস আমাদের কান্নার মাস। এ মাসে আমরা হারিয়েছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের সদস্য তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, পারভিন রোজী, ছোটভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণি এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবকে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, যিনি ছায়াসঙ্গিনী হিসাবে নেপথ্যে থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পথচলাকে সুগম করতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আগস্ট মাস ভাবলে অবাক লাগে। আমরা সৃষ্টিকর্তার লীলা বুঝি না, বোঝার ক্ষমতাও আমাদের নেই। আমি অবাক হয়ে যাই। এ মাসে বেগম মুজিব এলেন, শেখ কামাল এলো। আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সবাই চলে গেলেন। আমি বেগম মুজিবকে নিয়ে দুই-একটি কথা বলতে চাই। বেগম মুজিব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গিনী।
সৈয়দ শামসুল হকের একটি কথা মনে পড়ে-‘বেগম মুজিবের ডাক নাম ছিল রেণু। সেই রেণু থেকে সুরভিত ফুলের রেণু হয়ে যিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনকে ভরিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব।’ তার মানবিকতা বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতাকে বিপদে-আপদে সবকিছুতে সাহস ও নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়েছিল। যিনি স্কুলে যাননি, কলেজে যাননি, কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর চোখে সারা পৃথিবীকে দেখেছেন, সেই মহীয়সী নারী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বুলেটে নির্মমভাবে নিহত হন। নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ঘাতকদের বলেছিলেন, ‘আমাকেও মেরে ফেলো।’
আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে সেই মহীয়সী নারীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, যিনি সত্যিকার অর্থে জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন এবং শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি স্বশিক্ষিত বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব। বেগম মুজিব, সেই ছোট্ট রেণু-সংবেদনশীল মন নিয়ে যিনি তার স্বামীর সব কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছিলেন। আমি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পড়েছি-রেণু যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এসেছিলেন, তখন শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে পুত্রবধূ ও মেয়ের স্নেহ দিয়েছিলেন।
আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা বলেন, ঘরের লোকদের কাছ থেকে অনেক কিছুর সমর্থন পাওয়া যায় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সহযোগিতা বা সমর্থনের অভাব ছিল না। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে থেকেছেন খুব অল্প সময়। কিন্তু যখন বাড়িতে এসেছেন, তখন সেই সময়টুকু সোনার আলোয় ভুবন ভরিয়ে দিয়েছেন রেণু, বেগম মুজিব।
৫ বছর বয়সে তিনি মাকে হারালেন এবং ৩ বছর বয়সে হারালেন বাবাকে। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান রেণুকে শেখ মুজিবের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। একদিকে বালিকা বধূ, অন্যদিকে সেই শ্বশুর-শাশুড়ি। আমি বলব, গোপালগঞ্জের মাটি ধন্য যে তারা এরকম একজন নারীকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু মাঠে ফুটবল খেলছেন, আবার ছাত্রদের নিয়ে সংগঠন করছেন-ছায়াসঙ্গিনী হিসাবে প্রতিটি কর্মকাণ্ডে বাড়ি থেকেই বেগম মুজিব সাহস জুগিয়েছেন। এরকম একজন সঙ্গিনী আল্লাহর অশেষ রহমত ও দান। আমরা দেখি, সমাজে যারা উচ্চ শিখরে, সেসব নেতার আশপাশের লোকগুলো, বিশেষ করে যারা কাছের লোক-তারা বেশি উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে। কিন্তু বেগম মুজিবের মধ্যে এ জিনিসটি ছিল না। আমরা জানি, ৩২ নম্বরে তিনি তার পরিজন নিয়ে সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন। সাধারণ মানুষ তার কাছে আসতে পারবে না ভেবে তিনি বঙ্গভবনে পর্যন্ত গেলেন না। এ থেকে বোঝা যায় তিনি জনসাধারণের কত আপনজন ছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে শুনেছি, বঙ্গবন্ধু যখন প্যারোলে আসবেন তখন পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে প্যারোলের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন বঙ্গমাতা। আমাদের দেশের সাধারণ অবস্থায় আমরা জানি, কোনো ভদ্রমহিলার স্বামী তার কাছে আসবে, এ আকুলতা, এ ব্যাকুলতা স্বাভাবিক। কিন্তু তার বিপরীতে বেগম মুজিব প্রতিটি আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তার স্বামীকে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সাহস জুগিয়েছিলেন।
বঙ্গমাতা যখন শুনলেন বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে, খানসেনারা পরাজয়বরণ করেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, সেই সময় বেগম মুজিব এক ঝটকায় পাকিস্তানের পতাকা ভেঙে পায়ে চেপে টুকরো করে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে-এ সংবাদে তিনি বিজয়ের আবেগে এতটাই আন্দোলিত হয়েছিলেন। তাকে যে বাড়িটিতে আটকে রাখা হয়েছিল, সেই বাড়িটি খানসেনাদের পাহারায় ছিল, তারা ইচ্ছা করলে তাকে মেরেও ফেলতে পারত, কিন্তু তিনি মৃত্যুর কোনো পরোয়া করেননি।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময় যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মেয়েদের মায়ের মমতায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তিনিই বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। তিনি একটা সময় বঙ্গবন্ধুকে অনেক কাছে পেয়েছিলেন। সেটা হলো বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে গেলেন, তিনিও সঙ্গে গেলেন। বোধহয় তখনই তিনি পরম মমতায় বঙ্গবন্ধুকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের ভয়ংকর প্রত্যুষে ঘাতকদের বুলেটের সামনে নির্ভীক বঙ্গমাতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল, ‘আমাকেও মেরে ফেলো’। কবির ভাষায় বলি-
‘পাড়ি দিতে নদী, হাল ভাঙে যদি, ছেঁড়ে যদি তার কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছো, আমি আছি।’
বেগম মতিয়া চৌধুরী : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।