অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল: প্যান্ডেমিক যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে, প্যান্ডেমিকে হাপিয়ে উঠা মানুষ তখন যে কতটা স্বস্তিতে এই রমজানে সেটা ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন একাধিক ইফতারের দাওয়াতে লেগে যাচ্ছে ইফতার জট। গেল সোমবার দিনটা আমার জন্যও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। আগে থেকেই কথা ছিল এই দিনটিতে আমার ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের ইফতার অনুষ্ঠানটি আয়োজনের। সেই অনুযায়ী আয়োজনও সব চুড়ান্ত। ধানমন্ডির অভিজাত একটি রেস্টুরেন্ট ভাড়া করে দাওয়াত কার্ড বিলি করা যখন শেষ, তখনই ভারতীয় মান্যবর হাইকমিশনাররের ইফতারের দাওয়াতটি পেলাম ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে।
স্বীকার করতে দিধা নেই, একটু দ্বিধাতেই পরে গিয়েছিলাম শ্যাম আর কুলের মধ্যে কোনটা রাখি বাছাই করতে গিয়ে। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘যা আছে কপালে, দুটোতেই যাবো’। ভারতীয় হাই কমিশনারের দাওয়াতটুকু রক্ষা করেই ছুটবো নিজের সহকর্মীদের সাথে ইফতারে যোগ দিতে, এমনি একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে পা রাখলাম পাঁচ তারকা হোটেলটির বলরুমে। কপাল সবিশেষ ভালো বলতে হবে, পথে জ্যাম প্রায় পেলাম না বললেই চলে। ধানমন্ডি থেকে শাহবাগে গন্তব্যে পৌঁছাতে এক ঘন্টাও লাগলো না। আজকের ঢাকার বাস্তবতায় এটা যে একরকম চিন্তার বাইরে মানতেই হবে।
যেমনটা প্রত্যাশা করিনি জ্যামটা তেমন হলেও, ইফতার অনুষ্ঠানটিতে লোক সমাগম হয়েছে প্রত্যাশা মতই। লোক বললে ভুল বলা হবে, বলা উচিত ভিআইপিদের সমাবেশ, তাও আবার বাছাই করা ভিআইপিদের। কে নেই সেই দাওয়াতে। মন্ত্রী পরিষদের মাননীয় সদস্যবর্গ থেকে শুরু করে মাননীয় সাংসদ ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধি, ঊর্দ্ধতন বেসামিরক ও সামরিক কর্মকর্তা, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি, পেশাজীবি, মিডিয়ার বন্ধুরা সবাই আছেন।
কোভিড প্যান্ডেমিকটি শুরু হওয়ার পর অনেকের সাথেই এভাবে দেখা হওয়াটা এটাই প্রথম। কাজেই অন্যরকম একটা ভালো লাগার আমেজ গোটা বলরুমটা জুড়ে। সবাই সবার সাথে কথা বলছেন, কুশলাদী বিনিময় করছেন । যাকে বলে এক কথায় দারুন। ভারতের মান্যবর হাইকমিশনার ও তার অন্যান্য সহকর্মীবৃন্দ ঘুরে ঘুরে সবার দেখভাল করছেন আর কুশল বিনিময় করছেন। এক পর্যায়ে শুরু হলো অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন মান্যবর হাই কমিশনার। প্যান্ডেমিক শুরু হওয়ার পর দেশ বরেণ্য মানুষগুলোকে আবারো একখানে পেয়ে নিজের আনন্দের কথা জানাতে ভুল করলেন না। দ্রুতই বক্তব্য শেষ করলেন তিনি। স্বভাবসুলব রসিকতাচ্ছলেই বললেন তার সহকর্মীরা তাকে বলছেন তার হাতে বক্তব্য দেয়ার জন্য সময় আছে আর মোটে মিনিট দুয়েক।
একটু অবাকই হলাম, কারণ হাত ঘড়ির কাটা বলছে আজান দিতে তখনও ঢেড় বাকি। অবাক হওয়ার বাকি ছিল আমার এবং সেই সাথে বলরুমে উপস্থিত সম্ভবত আরো অনেকেরই। হাই কমিশনারের অনুরোধে ইফতার মাহফিলে মোনাজাত ধরলেন মাননীয় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মহোদয়। দীর্ঘ মোনাজাতে স্রষ্টার দরবারে বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট সব শহীদ আর সাথে ৩রা নভেম্বর আর ২১শে আগস্টের শহীদদের জন্যও প্রার্থনা করলেন তিনি। অবশ্যই বাদ গেলেন না একাত্তরের শহীদরাও।
প্রার্থনায় উঠে এলো ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী আর দীর্ঘ মেয়াদে মৈত্রীময় সম্পর্কের প্রত্যাশার বিষয়টিও। মন্ত্রী মহোদয়ের দীর্ঘ মোনাজাত শেষে আরেকজন মওলানা পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে তেলাওয়াত করলেন। অতঃপর আযান পড়ায় আমরা যে যার মত ইফতারে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।
ইফতার শেষ করে আর পথে আবারো আরেক দফা কুশল বিনিময় শেষে যখন ছুটছি আমার কলিগদের সাথে ইফতারের আনন্দটুকু ভাগাভাগি করে নিতে, তখন অভ্যাশবসে গাড়িতে বসে মোবাইলের টাচ স্ক্রীনে টোকাটোকি করতে গিয়ে চোখে পড়লো খবরটি। খররটি প্রকাশিত হয়েছে একটি আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায়, হেজিপেজি কোন জায়গায় না। সদ্যই গতিচ্যুত হয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজী। শেষ দিনে অনেক নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে আস্থাভোটে পরাজিত হন তিনি। সে প্রসঙ্গে আরেকদিন লেখার ইচ্ছে আছে। তবে যে নিউজ ফিডটি আমার টাচ স্ক্রীনের পর্দায়, সেটিও জনাব নিয়াজীর গদিচ্যুতি সংক্রান্তই।
মিডিয়ার কল্যাণে এটি এখন সবারই জানা যে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে আস্থাভোটের ঘন্টাখানেক আগে ইমরান খানের সাথে দেখা করেন পাকিস্তানের স্বশস্ত্র বাহিনীগুলোর সর্বাধিনায়ক জেনারেল বাজোয়া। সাথে ছিলেন আইএসআই প্রধানও। কি হয়েছিল তাদের সেই স্বাক্ষাতে তা এখন ‘এনি বডিজ গেস’। পত্রিকাটি বলছে জেনারেল বাজোয়াকে বরখাস্ত করার আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন ইমরান। খবর পেয়ে ছুটে আসেন দুই জেনারেল।
পত্রিকাটি বলছে তখনও ক্ষমতাশীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে চড়, আর এমনকি লাথিও মারেন এই দুই জেনারেল। তাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনের একটি কক্ষে এক ঘন্টা আটকেও রাখা হয়েছিল। এরপরই শেষ বল পর্যন্ত না খেলেই ইনিংস ডিক্লেয়ার করেন জনাব ইমরান খান নিয়াজী।
খবরটি যতই পরছিলাম ততই অবাক লাগছিল। না, পাকিস্তানের কথা ভেবে না। ওদেশটি গোল্লায় গেছে অনেক আগেই, চুলোয় যাক আরো বেশি করে, তাতে আমার থোরাই পরোয়া। আমি ভাবছি, যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম, তার অসারতার কথা। আরো একবার প্রমাণিত হলো কত বড় ভুল ছিল পাকিস্তান নামক দেশটির জন্মের এই তত্ত্বটি। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রণেতা স্যার সৈয়দ আহমেদ আর পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যদি আজ বেঁচে থাকতেন, আমি নিশ্চিত অমন খবর জানার পর তারা নিকটস্থ কলাগাছেই গলায় দড়ি দিতেন। যে ভারতকে ভাঙ্গা হয়েছিল মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, সেই ভারতীয় হাই কমিশনের আয়োজনে ঢাকায় অনুষ্টিত হচ্ছে ইফতার আর সেখানে করা হচ্ছে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত, মোনাজাত ধরছেন আমাদের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়।
অথচ অন্যদিকে মুসলমানের জন্য সৃষ্ট পাকিস্তানে মুসলমান জেনারেলের চড়-লাথি খেয়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন মুসলমান প্রধানমন্ত্রী। সত্যি কি বিচিত্র ঐ দেশ! ইফতার থেকে বেড়িয়ে আসার পথে ভারতের মান্যবর হাই কমিশনারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসতে ভুল করিনি ঠিকই, তবে তারপরও মনে হলো অমন অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারন ও লালন করার জন্য তিনি ও তার সরকার আর সহকর্মীরা আরেক দফা ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
(লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের প্রধান ও সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।