কোনো এক রাতে, ঢাকার গুলশানে ফেরার পথে রিকশায় বসা তানজিনার হঠাৎ গলা শুকিয়ে এলো। পেছনে বসা যাত্রীর হাত অস্বাভাবিকভাবে তার কোমড়ে স্পর্শ করছে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, শ্বাস আটকে আসে। কী করবে? চিৎকার করবে? লাফিয়ে পড়বে? নাকি অসহায়ভাবে কাঁদবে? এই বিভীষিকা প্রতিদিন হাজারও নারীর জীবনে নেমে আসে—রাস্তায়, অফিস লিফটে, গণপরিবহনে, এমনকি আপন ভুবনে। নারীদের আত্মরক্ষা কৌশল শুধু মার্শাল আর্টের কসরত নয়; এটি এক প্রাণরক্ষাকারী বিজ্ঞান, যা আপনার আত্মবিশ্বাসকে অস্ত্রে পরিণত করে। এই গাইডে শিখবেন কীভাবে বিপদ আঁচ করবেন, জরুরি পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেবেন, এবং শারীরিক প্রতিরোধের সহজ কৌশলে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন। ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী, এবং স্বনামধন্য সেলফ ডিফেন্স প্রশিক্ষকদের পরামর্শে তৈরি এই জীবনরক্ষাকারী ম্যানুয়ালটি আপনার পকেটে থাকা উচিত।
জরুরি পরিস্থিতি চিনবেন যেভাবে: সচেতনতাই প্রথম আত্মরক্ষা
আত্মরক্ষার ৮০% হলো সিচুয়েশনাল অ্যাওয়ারনেস বা পরিস্থিতিগত সচেতনতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরেনসিক সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক বলছেন, “আক্রমণকারীরা শিকার বাছাইয়ের সময় সহজ লক্ষ্য খোঁজে—যারা মোবাইলে ব্যস্ত, হেডফোনে বিভোর, বা অন্ধকারে একা হাঁটছে।” ২০২৩ সালে বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ৬৭% নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে রাত ৮টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে, যেখানে আক্রান্তার ৮০% ছিলেন একা বা জনমানবশূন্য স্থানে।
সচেতনতা বাড়ানোর তিনটি সোনালি নিয়ম:
১. ৩৬০ ডিগ্রি স্ক্যানিং: রাস্তায় হাঁটার সময় প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একবার পেছন তাকান। বিশেষ করে লিফট, সিঁড়ি, বা পার্কিং লটে।
২. গুট-ফিলিংকে বিশ্ব করুন: যদি কারো আচরণে অস্বস্তি হয়, তাড়াতাড়ি নিরাপদ জায়গায় চলে যান। “অনুভূতি কখনো মিথ্যা বলে না,” বলছেন সাইকোলজিস্ট ড. ফারহানা রহমান।
৩. ডিজাস্টার জোন চিহ্নিতকরণ: রাস্তায় চলার সময় নিরাপদ আশ্রয়স্থল (দোকান, ব্যাংক, পুলিশ বক্স) ম্যাপ করে রাখুন।
বাস্তব অভিজ্ঞতা: চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রী সাদিয়া (নাম পরিবর্তিত) শেয়ার করেন, “ক্যাম্পাসে এক সিনিয়রের আচরণ অস্বস্তিকর হলেও আমি পাত্তা দিইনি। একদিন ল্যাবে আটকে গেলে সে বলল, ‘চুপিচুপি সম্পর্ক রাখলে ক্যারিয়ারে সাহায্য করব।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্সিপাল অফিসে গিয়ে রিপোর্ট করি। পরে জানলাম সে আগে তিনজনের সঙ্গে এমন করেছে।”
শারীরিক আক্রমণের মুখে তাৎক্ষণিক করণীয়: সহজ কৌশলে আত্মরক্ষা
যখন কথাবার্তায় কাজ না হয়, তখন শারীরিক প্রতিরোধই শেষ ভরসা। কিন্তু মনে রাখবেন: প্রতিরোধের লক্ষ্য হবে আক্রমণকারীকে অচল করে পালানো, নয় তাকে ‘পরাজিত’ করা। বাংলাদেশ ক্যারাটে ফেডারেশনের প্রধান প্রশিক্ষক শফিকুল ইসলামের মতে, “৭০% আক্রমণ থামে শুধু জোরে চিৎকার বা প্রতিবাদ করলেই।”
জরুরি মুহূর্তে ৫টি কার্যকরী কৌশল (চিত্র সহ বর্ণনা):
১. চিৎকার নয়, ‘ফায়ার!’ বলুন: “ছাড়!” বা “আগুন!” বললে লোকেরা বেশি সতর্ক হয়। এতে আক্রমণকারী হতবাক হয়।
২. নাক-চোখ-কুঁচকিতে আঘাত: আঙ্গুল সোজা করে চোখে ঠেস দিন (থাম্বস ইন আইস), হাতের তালু দিয়ে নাকের নিচে জোরে আঘাত করুন, বা হাঁটু দিয়ে কুঁচকিতে মারুন।
৩. চুল ধরা মোকাবিলা: দুই হাত দিয়ে আক্রমণকারীর হাত চেপে ধরে নিচে ঝুঁকে পড়ুন। এতে তার হাতের কব্জি ভেঙে যেতে পারে।
৪. পেছন থেকে ধরা: কোমর ধরা হলে হাতের কনুই পেছনে দিয়ে পাঁজরে জোরে আঘাত করুন। গলা চেপে ধরলে তার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে কামড় দিন।
৫. হাত ধরা মোকাবিলা: আপনার হাত যদি কেউ ধরে, তার বৃদ্ধাঙ্গুলের গোড়ায় জোরে চাপ দিন বা ঘুরিয়ে ছাড়ান।
প্রশিক্ষকের টিপস: “প্রতিটি মুভ ১০ বার অনুশীলন করলে মাংসপেশি স্মৃতি তৈরি করে,” বলছেন ঢাকার ‘স্ট্রং উইমেন সেলফ ডিফেন্স’-এর ফাউন্ডার তাসনিমা হক। “আর গয়না বা স্কার্ফ পরলে তা আক্রমণকারীর হাতে আটকানোর ঝুঁকি বাড়ে।”
প্রযুক্তি ও দৈনন্দিন জিনিস দিয়ে আত্মরক্ষা: আপনার পার্সই হতে পারে হাতিয়ার
মোবাইল অ্যাপ থেকে শুরু করে পার্সের চাবি—সবই হতে পারে আপনার অস্ত্র। বাংলাদেশ আইসিটি ডিভিশনের ‘নারী সুরক্ষা’ অ্যাপ (ডাউনলোড লিংক: https://women.gov.bd)-এ আছে জিপিএস লোকেশন শেয়ার, জরুরি কল বাটন, এবং কাছের থানার হেল্পলাইন।
দৈনন্দিন জিনিস দিয়ে আত্মরক্ষার উপায়: | জিনিস | ব্যবহার পদ্ধতি |
---|---|---|
চাবির রিং | আঙ্গুলের ফাঁকে চেপে ধরে চোখ/গলায় আঘাত | |
পারফিউম বোতল | আক্রমণকারীর চোখে স্প্রে করুন | |
হ্যান্ডব্যাগ | দুই হাতে ধরে শক্ত করে পেটে বা মাথায় মারুন | |
পেন/পেন্সিল | খোঁচা দেবার জন্য ব্যবহার করুন |
সতর্কতা: পেপার স্প্রে বাংলাদেশে আইনসম্মত, তবে এর মেয়াদ থাকে মাত্র ২ বছর। ন্যাশনাল লিগ্যাল এইড অর্গানাইজেশনের পরামর্শ: “কোনো অস্ত্র ব্যবহারের আগে স্থানীয় আইন জেনে নিন।”
মানসিক ও আইনি প্রস্তুতি: আঘাতের পর যা করবেন
আক্রমণের পর ৭২ ঘণ্টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. শামসুল আলম বলেন, “ধর্ষণের শিকার হলে গোসল করবেন না, কাপড় বদলাবেন না। সঙ্গে সঙ্গে মেডিকো-লিগ্যাল পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যান।”
আইনি পদক্ষেপ:
১. এফআইআর দায়ের: নিকটতম থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ করুন। প্রত্যাখ্যান করলে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠান।
২. মেডিকেল রিপোর্ট: সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পরীক্ষা করা যায়।
৩. আইনি সাহায্য: বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন ল’য়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (BNWLA) বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেয়।
মনস্তাত্ত্বিক পুনর্বাসন জরুরি। কাউন্সেলর সালমা আক্তারের পরামর্শ: “আত্মহত্যার চিন্তা এলে সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯-এ কল করুন বা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (০১৭১৬-৯০০৮০০) হেল্পলাইনে যোগাযোগ করুন।
কোথায় পাবেন আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ?
বাংলাদেশে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে প্রশিক্ষণের সুযোগ:
- বাংলাদেশ মহিলা সমিতি: ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে নারীদের জন্য সেলফ ডিফেন্স কর্মশালা (ফোন: ০২-৯৫৫৮৫৩৪)।
- আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK): গ্রামীণ নারীদের জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম (ওয়েবসাইট: http://www.askbd.org)।
- ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কর্মশালা (ফেসবুক পেজ: @yehbd)।
অনলাইন রিসোর্স:
- ইউনিসেফ বাংলাদেশের ‘নিরাপত্তা শিক্ষা‘ ভিডিও সিরিজ [YouTube লিংক]
- বাংলাদেশ পুলিশের ‘নারী ও শিশু সহায়তা’ ইউনিটের ওয়েবিনার (পেজ: @dhakapolice)
সফলতার গল্প: বরগুনার গ্রাম্য কিশোরী জারা (১৭) শেয়ার করেন, “স্থানীয় এনজিওর প্রশিক্ষণে শিখেছিলাম কীভাবে হাত ছাড়ানো যায়। একদিন স্কুল ফেরার পথে এক যুবক জোর করে ধরে ফেললে, তার পায়ে জোরে লাথি মারি। সে ভয় পেয়ে পালায়।”
নারীদের আত্মরক্ষা কৌশল কোনো ‘অতিরিক্ত দক্ষতা’ নয়—এটি প্রত্যেক নারীর মৌলিক অধিকার, যার উপর ভর করে দাঁড়ায় তার স্বাধীনতা ও সম্মান। আজই সিদ্ধান্ত নিন: আপনি শিকারের ভূমিকায় থাকবেন না, বরং নিজের জীবনরক্ষাকারী নায়ক হবেন। একটি ক্লাসে অংশ নিন, সুরক্ষা অ্যাপ ডাউনলোড করুন, বা অন্তত কাছের মানুষদের সঙ্গে এই গাইড শেয়ার করুন। মনে রাখবেন, আপনার সুরক্ষা শুধু আপনার দায়িত্ব নয়—এটি সমাজের সকলের কর্তব্য। প্রশিক্ষণ নিন, সচেতন হোন, এবং অন্য নারীদেরও উৎসাহিত করুন। কারণ, নিরাপদ নারী মানেই নিরাপদ বাংলাদেশ।
জেনে রাখুন
১. আত্মরক্ষার সরঞ্জাম (পেপার স্প্রে, স্টান গান) বাংলাদেশে আইনসিদ্ধ কি?
হ্যাঁ, কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার করা যায়, তবে শর্ত আছে। পেপার স্প্রে সাধারণত অনুমোদিত, তবে স্টান গান বা বৈদ্যুতিক শক ডিভাইসের জন্য বিশেষ লাইসেন্স লাগে। সর্বদা স্থানীয় থানায় জিজ্ঞাসা করে নিন এবং কোনো অস্ত্র কেনার আগে এর বৈধতা নিশ্চিত করুন। অপ্রয়োজনে এগুলো বহন করা বিপজ্জনক হতে পারে।
২. রাস্তায় হয়রানির শিকার হলে আইনি সহায়তা পাব কোথায়?
অভিযোগের জন্য ৯৯৯-এ কল করুন বা নিকটতম থানায় যান। বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পেতে যোগাযোগ করুন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (BNWLA) হটলাইন ০১৯২৩ ৮৮৮ ৮৮৮-এ। এছাড়াও, “আইন ও সালিশ কেন্দ্র” (ASK) নারী নির্যাতনের শিকারদের জন্য ফ্রি লিগ্যাল এইড দেয়।
৩. আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নিতে শারীরিকভাবে খুব ফিট হওয়া কি জরুরি?
মোটেই না। আত্মরক্ষার ৮০% কৌশলই নির্ভর করে মস্তিষ্কের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সচেতনতা এবং সহজ শারীরিক কৌশলের উপর। যেকোনো বয়স ও শারীরিক গঠনের নারী লিভার ফাংশন টেস্টিং, দৌড়ানো বা চাপ প্রয়োগের কৌশল শিখতে পারেন। প্রশিক্ষকরা শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী কৌশল শেখান।
৪. বাসায় একা থাকাকালীন কেউ দরজা ভাঙার চেষ্টা করলে কী করব?
প্রথমে দরজায় শক্ত তালা লাগান এবং পেছনের দরজা/জানালার পথ পরিষ্কার রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯-এ কল করুন এবং প্রতিবেশীদের সাহায্য চান। রান্নাঘর থেকে কড়াই বা ভারী জিনিস হাতে নিন। যদি আক্রমণকারী ভিতরে ঢুকে পড়ে, চিৎকার করে “আগুন লেগেছে!” বলুন—এতে আশপাশের মানুষ সতর্ক হবে।
৫. শিশু কন্যাকে আত্মরক্ষা শেখানোর সঠিক বয়স কোনটি?
৭-৮ বছর বয়স থেকেই সহজ কৌশল শেখানো শুরু করা যেতে পারে, যেমন “অ্যাডাল্টদের গোপন জায়গায় স্পর্শ করা উচিত নয়”, “অপরিচিত কারো গাড়িতে উঠা যাবে না”, এবং জোরে “না!” বলার সাহস। ১২ বছরের পর থেকে শারীরিক প্রতিরোধের বেসিক কৌশল শেখানো যেতে পারে। বাচ্চাদের ভয় না দেখিয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়ান।
৬. গণপরিবহনে হয়রানি হলে কীভাবে সাহায্য চাইব?
বাস/ট্রেনে হলে চালক বা কন্ডাক্টরকে জানান। মেট্রোরেলে ইমার্জেন্সি অ্যালার্ম বোতাম টিপুন। উবার বা পাঠাও ব্যবহার করলে অ্যাপে “শেয়ার মাই ট্রিপ” ফিচার চালু রাখুন এবং ড্রাইভারের রেটিং দিন। সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো জোরে বলতে শেখা: “আমাকে স্পর্শ করবেন না!”—এতে আশপাশের যাত্রীরা সচেতন হন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।