শিহাবুল ইসলাম : খুচরা বাজারে রডের দাম ৮-৯ মাসের মধ্যে প্রতি টনে ১০-১১ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সিমেন্টের দামও প্রতি ব্যাগে বেড়েছে ৪০ থেকে ৫৫ টাকা। বাংলাদেশে এই দুই পণ্য এর আগে কখনোই এত বেশি দামে বিক্রি হয়নি। উৎপাদনকারী কম্পানিগুলো জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে বিদেশ থেকে কাঁচামাল না আনতে পারা এবং জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা রড-সিমেন্টের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থায়ও বিঘ্ন ঘটেছে।
রাজধানীর আশপাশে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে ইট ও বালু। ইটের দাম প্রতি হাজারে বেড়েছে চার হাজার ৫০০ টাকা, লাল বালুর দাম প্রতি ট্রাকে বেড়েছে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা। সাদা বালুর দাম প্রতি ট্রাকে বেড়েছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা।
রড : খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরের শুরুতে বিএসআরএম কম্পানির ৭২ গ্রেডের ৫০০ ডাব্লিউ রড বিক্রি হতো প্রতি টন ৮৬-৮৭ হাজার টাকায়, যা এখন দোকানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৯৩ হাজার ৫০০ টাকায়। একইভাবে কেএসআরএম রড প্রতি টন ছিল ৮৪ হাজার টাকা, যা এখন ৯০ হাজার ৫০০ টাকা, আনোয়ার ইস্পাত ছিল ৮৩ হাজার ৫০০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৯১ হাজার টাকা, এসএএস ছিল ৭০ থেকে ৭২ হাজার টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৭ হাজারে। এ ক্ষেত্রে ৬০ ও ৭০ গ্রেডের রড একই দামে বিক্রি হচ্ছে। দোকানভেদে এই দাম ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা কমবেশি হতে পারে। গ্রামাঞ্চলে শহরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে, এক বছর আগের চেয়ে ৬০ গ্রেডের রডের দাম প্রায় ১৩.২৯ শতাংশ বেড়েছে। ডলার না থাকার কারণে দেশের ব্যাংকগুলো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না। একই সঙ্গে ডলারের দাম বাড়ার প্রভাবও পড়েছে রডের বাজারে। এ বিষয়ে স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও মেট্রোসেম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম একটু কমার পর আবার বাড়তে শুরু করেছে। বড় জাহাজে কাঁচামাল নিয়ে আসার জন্য বড় এলসি প্রয়োজন। কিন্তু বড় এলসি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাঁচামাল কম আসছে। ডলারের দাম বাড়া এবং এলসি না খুলতে পারার কারণে সাপ্লাই চেইন ফল করেছে। সামনের দিনগুলোতে যদি ব্যাংকগুলো এলসি না দেয় তাহলে দাম আরো বাড়তে পারে। আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আরো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
সিমেন্ট : সিমেন্টের দামও বেড়েছে। শাহ সিমেন্ট ছিল ৪৬৫ টাকা বস্তা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫২০ টাকা দরে। স্ক্যান সিমেন্ট ছিল ৪৮০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৪০ টাকায়, হোলসিম ছিল ৪৯০ টাকা, এখন ৫৫০ টাকা। প্রিমিয়ার সিমেন্ট ছিল ৪৫০ টাকা, এখন ৫০০ টাকা। বেঙ্গল সিমেন্ট ছিল ৪৫০ টাকা, এখন ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড়ের মেসার্স মদিনা স্টিল করপোরেশনের ম্যানেজার মো. দিদার হোসেন বলেন, দাম বাড়ার কারণে আগের চেয়ে এখন অন্তত ৪০ শতাংশ বিক্রি কমেছে। ২০২১ সালে রডের দাম প্রতি টন এখনকার চেয়ে ৮-৯ হাজার টাকা কম ছিল। আগে রড মাসে অন্তত ২০০ টনের মতো বিক্রি হতো, যা এখন ১২০-১২৫ টনে নেমেছে। সিমেন্ট বিক্রি হতো ১৫ হাজার ব্যাগ, এখন বিক্রি হচ্ছে ৯-১০ হাজার ব্যাগ।
ইট-বালু : চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রতি হাজার এক নম্বর ইটের দাম ছিল আট হাজার থেকে ৯ হাজার ৫০০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১২ হাজার ৫০০ থেকে ১৪ হাজার টাকায়। দুই নম্বর ইট ছিল সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার ৫০০ থেকে ১২ হাজার ৫০০ টাকায়। সাধারণত ছাদ ঢালাইয়ের জন্য ব্যবহার করা প্রতি ট্রাক লাল বালুর দাম ছিল আট হাজার থেকে আট হাজার ৫০০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। সাদা বালুর দাম ছিল এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা। আবশ্যকীয় এই পণ্যগুলোর দাম বাড়ার ফলে আবাসিক ও কমার্শিয়াল ভবনের প্রতি বর্গফুট জায়গার দামও বেড়েছে।
গাবতলীর মিরপুর বালুঘাটের ব্যবসায়ী মো. মফিজুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, ‘ভাটা থেকে ইট এখানে এনে আমরা বিক্রি করি। দাম বাড়লে আমাদেরও দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে হয়। বালু নদী থেকে আনতে হয়। ট্রলারে আনতে হয়, ট্রলার চলে তেলে। ফলে তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রড ও সিমেন্ট নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়। ফলে অনেকেই দাম কমার অপেক্ষা করছে।
সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলমগীর কবির বলেন, ‘মার্কেটে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে গেছে। তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। চট্টগ্রামের লাইটার ভেসেলের মালিকরা ২২ শতাংশ ভাড়া বেশি নিচ্ছেন। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে ডলারের দাম বাড়ার কারণে। সিমেন্টের বিক্রি কমে গেছে। আমাদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী সর্বোচ্চ উৎপাদন করলে খরচ কমে। কম উৎপাদিত হলে কম্পানিগুলোর খরচ বেড়ে যায়। এর আগে সিমেন্টের দাম এতটা কখনোই ওঠেনি।’
রড-সিমেন্টের দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা প্রভাব পড়েছে আবাসন খাতে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের দাম ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কিছু ছোট কম্পানি তাদের ভবনের কাজ বন্ধ রেখেছে। আবার যেসব কম্পানি ধীরগতিতে কনস্ট্রাকশনের কাজ করে তারা আরো ধীরগতিতে কাজ করছে। তারা রড-সিমেন্টের দাম কমার অপেক্ষায় রয়েছে।
ক্রিডেন্স হাউজিং কম্পানি লিমিটেডের একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রতি বর্গফুটে অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়ে গেছে। আমরা হাই রেঞ্জের লাক্সারিয়াস প্রডাক্ট তৈরি করি। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দাম অন্যান্য কম্পানির চেয়ে আগে থেকেই বেশি ছিল। অন্যান্য কম্পানি ১০ হাজার টাকা বর্গফুট বিক্রি করলে আমরা সেটা ১১ হাজার বা সাড়ে ১১ হাজার টাকায় বিক্রি করি। সে ক্ষেত্রে এলাকাভেদে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কমার্শিয়াল স্পেসের দামও বেড়েছে।’ সূত্র : কালের কণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।