মনোজ কুমার সাহা, বাসস: পদ্মফুলকে বলা হয় ‘জলের রানি’। এ রানি জলাভূমিতে তার অপার সৌন্দর্যের সম্ভার দিয়ে মানুষকে মোহিত করছে। বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে ফুটন্ত পদ্মফুলের সৌন্দর্য অপার্থিব। এমনই এক অনিন্দ সুন্দর বিল আছে গোপালগঞ্জে। এ বিলে শুধুই বর্ণিল পদ্মফুলের সমারোহ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই জলাভূমি দেখতে আপনাকে আসতে হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত নিজ জেলা গোপালগঞ্জে। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া লাল-গোলাপি ও সাদা পদ্মফুল এ বিলে ¯েœহের চাদর বিছিয়েছে পরম মমতায় । দূর থেকে তাকালে মনে হবে বিলের কালো পানিতে কেউ যেন হাতে ধরে মায়ের মমতায় সবুজ জমিনে লাল-গোলাপি ও সাদা পদ্মফুল সাজিয়ে রেখেছেন । এ যেন অপরূপ ও মনোহর পদ্মমেলা।
গোপালগঞ্জের পদœ বিল এখন পর্যটকদের আনাগোনায় এখন মুখরিত। প্রতিদিনই প্রকৃতির এ অপরূপ শোভা উপভোগ করতে আসছেন সৌন্দর্য পিপাসুরা। এ বিল পর্যটকের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। বর্ষাকালে বিল এলাকার মানুষের সাধারণত কোনো কাজ থাকে না। আর অখন্ড এ অবসরে পদ্মফুল তুলে বাজারে বিক্রি ও নৌকায় করে দর্শনার্থীদের ঘুরিয়ে বাড়তি আয় হচ্ছে স্থানীয় নিম্ন আয়ের মানুষের।
গোপালগঞ্জ বিলবেষ্টিত জেলা। এখানে ২২৯ টি বিল রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম সদর উপজেলার বলাকইড় বিল। গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে এ বিল অবস্থিত।
স্থানীয়রা জানান, আগে বিলে অল্প সংখ্যক পদ্ম ফুটত। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর থেকে বর্ষাকালে বিলে প্রাকৃতিকভাবেই হাজারো রংবেরঙের পদ্ম ফুটতে শুরু করে। আস্তে আস্তে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে এ পদ্মবিলের অপার রূপের কথা।
বলাকইড় গ্রামের পদ্মবিলের প্রায় পুরোটাজুড়েই ফোটে বিপুল সংখ্যক পদ্মফুল ফোঁটে। এ ফুলে খেলা করে ভ্রমরসহ বিভিন্ন কীট পতঙ্গ। পূর্ব আকাশে সূর্য উদয়ের সাথে সাথে বিলে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়। তাঁদের পদচারনায় সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখরিত থাকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বলাকইড় গ্রামের পদ্মবিলের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটেয়ে বয়েছে, লতা,পাতা, গুল্ম, কোথাও কচুরিপানা। এরই মাঝে ফুটেছে রয়েছে অগণিত পদ্ম। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ফুঁটে থাকা লাল-গোলাপি আর সাদা রঙের পদ্ম রঙ্গিন আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। পদ্মের স্নিগ্ধতার রং আর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা এই দুইয়ে মিলে যেন একাকার বিলের প্রকৃতি। আর এমন অপরূপ সৌন্দর্য হাতছানি দিয়ে ডাকে ভ্রমণপিপাসুদের। জলের রানি পদ্মের শোভা দেখতে বলাকইড় বিলে প্রতিদিনই পরিবার-পরিজন নিয়ে ভিড় করছেন অনেকে। বিভিন্ন শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেই আসছেন ভ্রমণপিপাসুরা। নৌকায় ঘুরে তাঁরা সৌন্দর্য উপভোগ করছেন ।
ভ্রমণপিপাসুদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন স্থানীয়রা। পদ্মফুলের চাহিদা থাকায় ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত বিল থেকে পদ্মফুল সংগ্রহ করা হয়। এ ফুল বাজারে বিক্রি করছেন অনেকে। বিল এলাকায় ফুলের দাম কম। শহরে প্রতিটি ফুল ৫ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি করছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। এ ছাড়া পাইকাররা এ বিলের পদ্মফুল দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন ।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন,পদ্মবিলকে ঘিরে বলাকইড়ে রাস্তা, বিশ্রামাগার, শৌচাগার সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সৃস্টি করা হয়েছে। এ কারণে পর্যটকরা সহজেই বিলের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছেন।
এ বিলে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী বাগেরহাটের সুবর্ণা ইসলাম বলেন, ভূস্বর্গ কাশমিরের মতোই অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলাকইড়ের পদ্মবিল। এ বিলের অপার প্রকৃতিক সৌন্দর্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘শুধু সৌন্দর্যপিপাসু তৃষিত হৃদয়ের পরিতৃপ্তিই নয়; আমাদের দেশে পদ্মফুল যদি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়, তবে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এ ফুল থেকে জন্মানো ফলের বীজ একটি পুষ্টিকর খাবার।’ তিনি সবাইকে পদ্মবিলে আসার আমন্ত্রণও জানান। বলেন, ভ্রমণপিপাসুরা এ পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগ না করলে বুঝবেনই না বিলে কী অপরূপ সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। ফুল, পাতা ছেড়া, বিলের পানিতে প্লাষ্টিক বোতল, পলিথিন, কেমিক্যাল জাতীয় পদার্থ না ফেলার জন্য পর্যটকদের তিনি অনুরোধ করেছেন। পশাপাশি তিনি বিলকে পরিবেশ দূষনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পর্যটকদের প্রতি আহবান জানান।
পদ্মবিল সবার জন্য অবারিত
এ পদ্মবিলে যেতে পারেন সবাই। আর রাজধানী ঢাকা থেকে এর দূরত্বও বেশি নয়। পদ্মা সেতুর বদৌলতে অনেকে আবার ঢাকা থেকে গিয়ে পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করে আবার একদিনেই ফিরে আসেন। মাওয়া হয়ে গেলে গোপালগঞ্জের দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। আর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে পাটুরিয়া হয়ে গোপালগঞ্জের দূরত্ব ২১০ কিলোমিটার।
ঢাকা থেকে যাবেন যেভাবে
রাজধানীর গুলিস্তান, সায়েদাবাদ বা গাবতলী থেকে গোপালগঞ্জে যাওয়ার রাতের বাসে উঠে পড়ুন। ভোর সাড়ে ৫ টা থেকে গোপালগঞ্জের উদ্দেশে বাস ছাড়ে। টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, এমাদ পরিবহন, দোলা, বিআরটিসি মধুমতি এক্সপ্রেস পরিবহনসহ অনেক বাস আছে। আরো আছে কমফোর্ট লাইন, গোল্ডেন লাইন পরিবহনের বাসও। এসব বাস পাটুরিয়া দিয়ে যায়। ভাড়া ৪৫০ টাকা আর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বাসের ভাড়া ৭০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। গোপালগঞ্জ শহরের পুলিশ লাইনস মোড়ে নামতে হবে। সেখান থেকে ইজিবাইক বা মাহেন্দ্র ভাড়া করে সদর উপজেলার বলাকইড় দক্ষিণপাড়া গ্রামে। ভাড়া নেবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সময় লাগবে ২০ থেকে ২৫ মিনিট।
এ ছাড়া পুলিশ লাইনস মোড় থেকে ইজিবাইকে করে গোপালগঞ্জ কাঁচাবাজার এলাকায় যাওয়া যায়। ভাড়া নেবে জনপ্রতি ১০ টাকা। এরপর সেখান থেকে বলাকইড়ের মাহেন্দ্র স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি দক্ষিণপাড়ার পীরু সরদারের বাড়ির কাছের সেতু। এ সেতুর নিচ থেকে নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়।
নৌকা ভাড়া ও ঘোরাঘুরির বৃত্তান্ত
দক্ষিণপাড়ার পীরু সরদারের বাড়ির কাছের সেতুর নিচ থেকে নৌকা ভাড়া করার পরে মাঝি প্রায় এক ঘণ্টায় দর্শনার্থীদের পুরো বিল ঘুরিয়ে দেখান। ভাড়া নেন ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। নৌকাগুলো বেশ বড়ই। একসঙ্গে ১০-২০ জন ভ্রমণ যায় এ নৌকায়। নৌকার মাঝি পলাশ জানান, সাধারণত শুক্র, শনিবারসহ ছুটির দিনগুলোতে পর্যটক বেশি থাকে।
রাতেই ঢাকা ফেরার সুবিধা
পদ্মবিল দেখে রাতের মধ্যে ঢাকায় ফিরতে চাইলে বিকেল ৫টায় ফিরতি বাসে উঠে পড়ুন। সময় লাগবে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা। গোপালগঞ্জ শহরের পুলিশ লাইনস মোড় ও সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনেই বিভিন্ন বাসের কাউন্টার। সেখান থেকে বাসে উঠে রাত ৮ টা থেকে ১০ টার মধ্যে ঢাকায় ফেরা যায়।
কী খাবেন
খাওয়াদাওয়া পর্বটা গোপালগঞ্জ শহরে সারলেই ভালো। শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে বেশকিছু ভালো হোটেল আছে। এখানকার হোটেল খান¯œাকস ‘বার বি কিউ’, ‘সিসিয়ান চায়নিজ রেস্টুরেন্ট’, ‘শম্পা হোটেল’, ‘শেখ ¯œাকস’ গোপালগঞ্জ ¯œাকস, ছোয়া রেষ্টুরেন্ট, ‘ঐশী রেস্টুরেন্টে’ নাশতা ও দুপুরের খাবার খেতে পারেন। দেশীয় খাবার ও বিলের তাজা মাছ খেতে চাইলে যেতে পারেন শহরের পোস্ট অফিসের মোড়ে। সেখানে তিন-চারটি হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে ‘বড়দার হোটেল’ ও ‘হোটেল রোমান্স’ প্রসিদ্ধ। হাতে সময় থাকলে চলে যেতে পারেন গোপালগঞ্জ শহরতলির বেদগ্রামের হোটেলগুলোয়। যেখানে ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে সুস্বাদু হাঁসের মাংস চেখে দুপুরের খাওয়া পর্বটি সেরে নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
কেউ যদি বিকেলে না ফিরে গোপালগঞ্জে থাকতে চান তবে ফিরে আসতে হবে শহরেই। কারণ বলাকইড় গ্রামে এখনো থাকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। শহরে এসে হোটেলে উঠতে পারেন। মাহিন্দ্রা স্ট্যান্ড থেকে নামলেই আছে পলাশ গেস্ট হাউস, জিমি হোটেল, হোটেল রাজ, হোটেল সোহাগ, হোটেল রিফাত প্রভৃতি। এগুলোতে এসি ও নন এসি রুম পাবেন। এসি রুমে ভাড়া পড়বে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা। নন এসি রুমের ভাড়া পড়বে ৭৫০ থেকে ১০০০ টাকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।