জুমবাংলা ডেস্ক : পাবর্ত্য অঞ্চল খাগড়াছড়ি জেলার বাসিন্দা বকুল চাকমা। উচ্চশিক্ষিত এ যুবক নিজ জেলায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছোটবেলা থেকেই বরিশালের ঝালকাঠিতে ভাসমান পেয়ারার হাটের কথা শুনতেন। এবছর পরিকল্পনা করেন ভাসমান সেই পেয়ারার হাট দেখবেন। গত শুক্রবার (২৯ জুলাই) সকালে কয়েকজনসহ উপস্থিত হন পেয়ারার ভাসমান হাট ভীমরুলীতে।
পেয়ারাচাষিদের কাছ থেকে কয়েক কেজি পেয়ারা কিনে হাতে উঁচু করে ধরে ছবি তোলেন। তখন তার চোখে-মুখে ছিল আনন্দের ঝিলিক। বহুল কাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়েছেন এমন উল্লাসে দেখা গেছে বকুল চাকমাকে।
তিনি বলেন, ‘পেয়ারার ভাসমান হাটের কথা এত বছর ধরে শুনেছি কিন্তু দেখতে পারিনি। ফেরিতে বেশি সময় লাগে সেই চিন্তায় এখানে আর আসা হয়নি। পদ্মা সেতু হওয়ায় খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকা হয়ে অল্প সময়ে এখানে আসতে পেরেছি। পেয়ারা দেখতেই এই প্রথম বরিশালে আসা।’
রাজধানীর ওয়ারী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা তুলসি আক্তার। ঝালকাঠির ভীমরুলীতে পেয়ারার ভাসমান হাট দেখতে এসেছেন তিনিও। তুলসি আক্তার বলেন, ‘ এমন একটি ভাসমান বাজার আমাদের দেশে আর নেই। এখানে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। কতটা যে ভালো লাগছে তা বলে শেষ করতে পারবো না।’
নড়াইল থেকে ৯টি মোটরসাইকেলে করে ১৮ জন যুবক আসেন এ ভাসমান পেয়ারার হাট দেখতে। এদের মধ্যে টিম পরিচালনাকারী শাহজাহান মৃধা জানান, এশিয়া মহাদেশে থাইল্যান্ডের পরে বাংলাদেশের একমাত্র ভাসমান পেয়ারা বাজার ভীমরুলীতে। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টন পেয়ারা দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। বাজারটা অনেক সুন্দর।
তিনি বলেন, ‘এখানে আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। ভ্রমণের জন্য ডিঙি নৌকা সংকট রয়েছে। সরকার বা জনপ্রতিনিধি যদি এসবের ব্যবস্থা করেন তাহলে এখান থেকেও প্রতিবছর অনেক টাকা রাজস্ব আয় হতে পারে।’
পিরোজপুরের তেজদাসকাঠি কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম। কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিজ পরিবারের সদস্যদেরও নিয়ে এসেছেন শিক্ষা সফরে। তিনি এখানকার আবাসন ও শৌচাগারের ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পেয়ারার বড় মোকাম ভীমরুলীতে কোনো আবাসন ও ভালো শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। এখানে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক আসেন। তারা আমাদের ওপর একটা বিরূপ ধারণা নিয়ে যান। দক্ষিণাঞ্চলের এ এলাকাকে আরও উন্নয়ন করা দরকার। এজন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা উচিত।’
পেয়ারার হাটে দায়িত্বরত বরিশাল রেঞ্জের নৌপুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মনিরুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে পদ্মা সেতু হওয়ার পর এখানকার পর্যটন স্পটগুলো ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে তাদের পছন্দের জয়গায় ভ্রমণ ও পরিদর্শন করতে পারেন সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতেও আমাদের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, ‘ঝালকাঠির ব্র্যান্ড পেয়ারা ও শীতলপাটি চাষিদের এতদিনের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উন্মোচন হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে। কারণ বিশ্বের পর্যটকরা এখন সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে ঝালকাঠি এসে পেয়ারা রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। একই সঙ্গে সরাসরি ন্যায্য মূল্যে বেশি করে কিনে নিতে পারবেন ঝালকাঠি পাটিকরদের হাতে তৈরি শীতলপাটি।’
ঝালকাঠি সদর উপজেলা, বরিশালের বানারিপাড়া ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার ৫৫ গ্রামজুড়ে রয়েছে পেয়ারা রাজ্য। ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ পেয়ারা অঞ্চলে প্রতিবছরের চেয়ে এবছর পর্যটকদের আগমন অনেক বেশি। পেয়ারার সবচেয়ে বড় মেকাম সদর উপজেলার ভীমরুলীর ভাসমান হাটে পর্যটকদের নিরাপত্তার সুবিধা দিতে ঝালকাঠি থানা পুলিশের পাশাপাশি রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশেরও অবস্থান। পর্যটকরা ড্রোন ও ক্যামেরা দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি স্মৃতি হিসেবে ছবি তুলছেন, ভিডিও ধারণ করছেন।
প্রতি বছর আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র এই তিন মাস পেয়ারার মৌসুম হলেও এবছর ফলন দেরিতে হওয়ায় শ্রাবণে পেয়ারা নামতে শুরু করেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান পেয়ার হাট বসে ভীমরুলীতে। এছাড়া হাট বসে ঝালকাঠি জেলার শতদশকাঠি, জগদীশপুর ও মাদ্রা; পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির (নেছারাবাদ) কুড়িয়ানা, আটঘর, আতা; বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার নেরার কাঠি, জাম্ভুদ্বীপ, ব্রাহ্মণবাড়ি ও সৈয়দকাঠিতে। দেশের বেশিরভাগ পেয়ারা উৎপাদন হয় এ তিন জেলার ৫৫ গ্রামে।
পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে শতাধিক ছোট বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন সকালে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় করে সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসেন পাইকারদের কাছে। তা কিনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সড়কপথে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সরবরাহ হচ্ছে পেয়ারা।
ঝালকাঠির কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারাচাষি আল আমিন মিয়া জানান, এবার মৌসুমের শুরুতেই ২০ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ পেয়ারা ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। পর্যটকদের কাছে খুচরা বিক্রি করলে প্রতি মণ ১ হাজার টাকারও বেশি দামে বিক্রি হয়।
স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ চাষিদের মতে, প্রায় ৩০০ বছর আগে ব্রাহ্মণকাঠি গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মন্ডল ও কালাচাঁদ মন্ডলের হাত ধরে ভারতের গয়া থেকে এখানে পেয়ারার আগমন। তখন থেকেই পেয়ারা চাষ শুরু হয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গোটা আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে।
কুড়িয়ানার নাম অনুসারে ‘কুড়িয়ানার পেয়ারা’ বলে সবার কাছে পরিচিত হলেও পেয়ারার চাষ এখন আর কুড়িয়ানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পেয়ারার চাষ এখন পাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিস্তার ঘটেছে। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠী, ধলহার, কঠুরাকাঠি, আন্দাকুল, জিন্দাকাঠি, ব্রাহ্মণকাঠি, আতা, জামুয়া, মাদ্রা; ঝালকাঠির ভীমরুলী, ডুমুরিয়া, জগদীশপুর, কাফুরকাঠি, শতদশকাঠিসহ স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়ার মোট ৫৫টি গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষাবাদ হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।