হেনরিখ হার্টজ ও গুগ্লিয়েলমো মার্কনির সমসাময়িক জগদীশ বসুই হলেন বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি ১৮৯৫ সালে প্রথম সাফল্যের সঙ্গে মাইক্রোওয়েভ উৎপাদন করেন এবং তার ধর্মাবলিও নির্ধারণ করেন। রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমের রিমোট সেন্সিং প্রথম প্রদর্শন করেন জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে। এর কদিন পর জগদীশ বসু কলকাতার টাউন হলে ৭৫ ফুট দূরে রাখা বারুদের স্তূপে আগুন জ্বালাতে সমর্থ হন নিজের উদ্ভাবিত মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশনের সাহায্যে।
১৮৯৫ সালে জগদীশচন্দ্রের চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল–এর জার্নাল, রয়্যাল সোসাইটির প্রসিডিংস ও ইংল্যান্ডের দ্য ইলেকট্রনিক জার্নালে। ১৮৯৬ সালে জগদীশচন্দ্র তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক সফরে যান ইউরোপে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ–তরঙ্গ পরিমাপক যন্ত্রটি। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে।
তাঁর বক্তৃতায় দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্যার জে জে থমসন, অলিভার লজ, লর্ড কেলভিনের মতো পদার্থবিজ্ঞানীরা। প্রথম বক্তৃতাতেই জগদীশচন্দ্র পৃথিবীবিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেন। জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক বক্তৃতার সাফল্যে পরাধীন ভারতের বাদামি বর্ণের মানুষের বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে ইংরেজদের তাচ্ছিল্যবোধ ও অবজ্ঞার ভাব কিছুটা হলেও বদলে গেল। লন্ডন ইউনিভার্সিটি জগদীশ বসুকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করল। ১৮৯৭ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন জগদীশচন্দ্র।
প্রথম ইউরোপ সফর শেষে কলেজে ফিরে এসে একটা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করা তো দূরে থাক, পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়াল। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের কাজের জন্য একটা ল্যাবরেটরি দাঁড় করিয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু অনুদানের জন্য অনুরোধ করে চিঠি লেখার পর যে উত্তর পেলেন, তা এ রকম: ‘ডক্টর বসু এখন মাসে পাঁচ শ টাকা মাইনে পান। কোন নেটিভ সরকারি চাকুরের মাসে পাঁচ শ টাকায় পোষাচ্ছে না বলাটা নেহাত বোকামি।’ পদে পদে অপমানের উদাহরণ আরও অনেক আছে।
কিন্তু কিছুতেই দমে গেলেন না জগদীশচন্দ্র। ইউরোপ সফরের সাফল্য তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বিদ্যুৎ–তরঙ্গ নিয়ে তিনি নতুন উদ্যমে গবেষণা শুরু করলেন। ১৮৯৭ সালে তাঁর তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি থেকে। ১৮৯৯ সালে গবেষণায় তিনি জড় বস্তুর মধ্যে প্রাণস্পন্দনের অনুরূপ সাড়া প্রত্যক্ষ করেন। তিনি লক্ষ করেন, প্রাণীদের মতো জড় বস্তুও বাইরের উত্তেজনায় সংবেদনশীল।
জড় ও জীবের এই গোপন ঐক্য সম্পর্কে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের কাছে প্রকাশের একটা সুযোগ এসে পড়ল। ১৯০০ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জগদীশ বসু দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপে গেলেন। বাংলা ও ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্যারিসে পদার্থবিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দেন এবং জড় বস্তুর সংবেদনশীলতা বিষয়ে তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করেন।
১৯০১ সালের মে মাসে রয়্যাল ইনস্টিটিউটের শুক্রবারের সান্ধ্য অধিবেশনে জগদীশচন্দ্র ‘দ্য রেসপন্স অব ইন–অর্গানিক ম্যাটার টু মেক্যানিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল সিমুলাস’ নামের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাতে তিনি বর্ণনা দেন যান্ত্রিক ও বিদ্যুৎ উদ্দীপনার প্রতি উদ্ভিদ ও প্রাণীর ‘সাড়া’সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষণের। এর আগেই সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং দেশীয় উপাদানে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে জগদীশ বসু একটা বৈদ্যুতিক সংবেদনশীল যন্ত্রের মডেল তৈরি করেছিলেন। গ্যালেনা বা লেড সালফাইড ব্যবহার করে যন্ত্রটির নাম দিয়েছেন গ্যালেনা ডিটেক্টর।
জগদীশচন্দ্র তাঁর পরীক্ষা করে দেখালেন, দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনায় বস্তুর সাড়া দেওয়া ক্ষীণ হয়ে যায়। যাকে বস্তুর ‘অবসাদ’ বলা যায়। এ অবস্থায় আলো বা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ প্রয়োগ করলে বস্তু আগের অবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু পরিবাহিতাসহ আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের মান কিছুক্ষণ ওঠানামা করে। তিনি প্রস্তাব করলেন, কোনো অত্যুজ্জ্বল বস্তু থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করলে কিছুক্ষণ যাবৎ যে উজ্জ্বল বস্তুটি একবার দেখা যায়, আবার অদৃশ্য হয়ে যায় বলে মনে হয়—এর কারণ চোখের রেটিনার পরিবাহিতাধর্মের স্পন্দন। জগদীশ বসুর আগে এভাবে কেউ চিন্তা করেননি।
১৯০১ সালে রয়্যাল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্রের। প্রবন্ধগুলোতে আলোক ও অদৃশ্য বেতারতরঙ্গের সদৃশ ধর্ম নিয়ে পরীক্ষালব্ধ ফল আলোচিত হয়েছে। ১৯০২ সালে লিনিয়ান সোসাইটিতে বক্তব্য দেন জগদীশচন্দ্র। সাড়া মাপার যন্ত্র ‘রেসপন্স রেকর্ডার’ তৈরি করার পদ্ধতি বর্ণনা করলেন জগদীশ। যন্ত্রটা অনেকটা কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের মতো।
উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও সংবেদনশীলতা মাপার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এ যন্ত্র। ১৯০২ সালের মে মাসে রয়্যাল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান–সংক্রান্ত শেষ গবেষণাপত্র, ‘অন ইলেকট্রোমোটিভ ওয়েভ অ্যাকম্প্যানিয়িং মেকানিক্যাল ডিস্টার্বিং ইন মেটালস ইন কন্ট্যাক্ট উইথ ইলেকট্রোলাইট’। তারপর তাঁর গবেষণা পুরোপুরি উদ্ভিদ ও প্রাণীর শারীরবৃত্তীয় ধর্মাবলি পরীক্ষার দিকে মোড় নেয়।
জগদীশ বসুকে আমরা পেলাম পৃথিবীর প্রথম বায়োফিজিসিস্ট হিসেবে। তিনি উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় গবেষণা করেছেন পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ ঘটিয়ে। এই পদ্ধতির বিস্তৃত প্রয়োগে উদ্ভিদের প্রাণচক্র ও শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়াসংক্রান্ত গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা জগদীশ বসুকে চিনলাম উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবে।
১৯০২ সালে প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের প্রথম বই রেসপন্স ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন-লিভিং। ১৯০৩ সালে জগদীশচন্দ্র বসু সিআইই (Companionship of the Indian Empire) উপাধি লাভ করলেন। ১৯০৬ সালে তাঁর দ্বিতীয় বই প্ল্যান রেসপন্স: অ্যাস আ মিনস অব ফিজিওলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশনস প্রকাশিত হয় লংম্যান গ্রিন কোম্পানি থেকে। পরের বছর প্রকাশিত হলো তাঁর তৃতীয় বই কমপ্যারেটিভ ইলেকট্রো-ফিজিওলজি: আ সাইকো ফিজিওলজিক্যাল স্টাডি।
১৯১১ সালে দিল্লির দরবারে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে জগদীশচন্দ্রকে সিএসআই (Companionship of the star of India) উপাধিতে ভূষিত করা হয় জগদীশ বসুকে। ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯১৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। তারপর আরও দুই বছর বাড়ানো হয় তাঁর চাকরির মেয়াদ।
সে বছর প্রকাশিত হয় তাঁর চতুর্থ বই রিসার্চ অন ইরিট্যাবিলিটি অব প্ল্যান্টস। ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন তিনি। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ইমেরিটাস অধ্যাপক পদে নিয়োগ করে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার নাইট উপাধি দেয় জগদীশচন্দ্রকে। তাঁর নামের আগে যোগ হলো স্যার।
১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর ৫৯তম জন্মদিনে প্রতিষ্ঠিত হলো বসু বিজ্ঞান মন্দির। উদ্বোধনী বক্তৃতার শুরুতেই স্যার জগদীশচন্দ্র ঘোষণা করলেন, ‘আমার স্ত্রী ও আমি এই গবেষণাগারের জন্য সর্বস্ব দান করছি।’ জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু নিঃসন্তান ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের সবকিছু তাঁরা দান করেছিলেন বাংলার বিজ্ঞান প্রসারের জন্য।
১৯১৮ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে জগদীশচন্দ্র তাঁর লাইফ মুভমেন্ট ইন প্ল্যান্টস নামে বৃহৎ বইটি চার খণ্ডে প্রকাশ করেন। ১৯১৯-২০ সালে পঞ্চম বৈজ্ঞানিক সফরে আবার ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দেন। ১৯২০ সালের শুরুতে স্যার জগদীশচন্দ্রকে রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কমিটির কয়েকজন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের ফলাফল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। ফলে একটি কমিটি গঠন করা হয়, যারা জগদীশচন্দ্রের যন্ত্র পরীক্ষা করে দেখল।
গাছের বৃদ্ধির হার শামুকের গতির চেয়েও দুই হাজার গুণ কম। একটি সাধারণ গাছ এক সেকেন্ডে এক ইঞ্চির এক লাখ ভাগের এক ভাগ বাড়ে। অর্থাৎ এক লাখ সেকেন্ড বা প্রায় আটাশ ঘণ্টায় এক ইঞ্চি বাড়ে। এই অতি ধীর চলনের গতি লিপিবদ্ধ করার জন্য খুবই সংবেদী যন্ত্রের দরকার, যা আবিষ্কার করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। ম্যাগনেটিক ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে গাছের বৃদ্ধিকে ১০ লাখ গুণ বাড়িয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।