এইচ এম শরিফুল হাসান: ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এই দুই উপন্যাসের মূল সব চরিত্রের নাম এক। সেই রাবেয়া, খোকা, মন্টু, রুনু- এগুলোই। গল্পের বর্ণনাও প্রায় একই। শুধু পরিণতি আলাদা।
হুমায়ূন আহমেদ স্যার নিজেই লিখেছেন, শঙ্খনীল কারাগার আমার প্রথম লেখা উপন্যাস, যদিও প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরকে। এখন উনি কেন এইভাবে লিখলেন, সেই ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই তাঁর কাছে ছিল।
তবুও একটা ব্যাপার মনে হয়- একই সদস্য সংখ্যা, এমনকি একই নাম হতে পারে যাদের আর্থিক অবস্থাও প্রায় অভিন্ন, এমন হওয়াটা কিন্তু এ দেশে খুবই সম্ভব। আমরা তো এরকমটা হতেই দেখি আমাদের চারপাশে।
শঙ্খনীল কারাগারের ভূমিকায় স্যার লিখেছেন, প্রথমত নতুন নাম খুঁজে পাই নি বলে, দ্বিতীয়ত এই নামগুলির প্রতি আমি ভয়ানক দুর্বল বলে। কার্যকারণ ছাড়াই যেমন কারো কারো কিছু কিছু দুর্বলতা থাকে, এও সেরকম।
বইটার নাম তিনি কবি রফিক কায়সারের কবিতা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এর নামে দেন।
শুরুতেই বলে দিয়েছেন, ঢাকার মার্ক্সবাদী বিপ্লবী সোমেন চন্দের লেখা ‘ইঁদুর’ ছোটগল্প পড়ে মধ্যবিত্তদের জীবন নিয়ে গল্প লিখতে উৎসাহিত হন। সোমেন চন্দকে সেসময় কবি সুকান্তের কাছাকাছি প্রতিভার গল্পকার গণ্য করা হত৷ যদিও দুজনের কেউই ২২ বছরও বাঁচতে পারেননি।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কর্মজীবন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। বাকৃবিতে শিক্ষকতা করার সময়েই তিনি শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসটি লিখেছিলেন।
১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৭৪ সালের মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরি করেন।
তারপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি জানান, হুমায়ূন আহমেদ বাকৃবিতে শিক্ষকতা করার সময়ই তার বিখ্যাত উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার লিখেন।
মূল চরিত্রের নাম এক হলেও কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ যে অদ্ভুত খেলাটা খেলেছেন পাঠকের সাথে সেটা হচ্ছে- নন্দিত নরকের রাবেয়া আর শঙ্খনীল কারাগারে যে রাবেয়া, কিংবা দুই গল্পের যে দুইজন মন্টু, তারা কিন্তু আলাদা মানুষ। তিনি দুটো ভিন্ন গল্প বলেছেন একই নাম দিয়ে, দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র এঁকেছেন। এদের পরিণতিও হয় ভিন্ন ভিন্ন।
একই পরিবারের এতগুলো মানুষ কাছাকাছি থেকেও কেউ কখনো বুঝতে পারে না কার মনে কি চলছে? কারণ প্রতিটি মানুষই তার নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করে রাখে।
এই যে প্রতিটি মানুষ নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করে রাখে, যে দেয়ালের মধ্যে কখনো কেউ প্রবেশ করতে পারে না, যে দেয়ালের ভেতরের কথা গুলো কখনো কেউ জানতে পারে না— এই অদৃশ্য দেয়ালের নামই ‘শঙ্খনীল কারাগার’।
পুরো বইটা পড়া হয়ে গেলেও মাথার ভেতর দুটি লাইন ঘোরাফেরা করে, ভালবাসা না পেতে পেতে মনের মধ্যে সীমাহীন ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যে হাহাকার, সেই হাহাকারের কথাই যেন বলে এই দুটো লাইন—
‘দিতে পারো একশো ফানুস এনে?
আজন্ম সলজ্জ সাধ— একদিন আকাশে কিছু ফানুস ওড়াই!’
ওদিকে তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’র আরেকটা বিশেষত্ব আছে। হুমায়ূন দেখান যে ঘরের মধ্যেও আমাদের নারীদের সাথে কি অন্যায় হতে পারে।
লেখক কিন্তু এই দুই উপন্যাসের কোথাওই কোন মেসেজ দেন না। যেমন তােমাদের এইটা করতে হবে, ওইটা করলে হবে না। উনি বলেন না, মন্টুর পথেই হাঁটতে হবে। বা সেটাই ছিল সঠিক পথ।
হুমায়ূন আহমেদ শুধু গল্প বলে যান।
এত এত বই না লিখে তিনি যদি শুধু এই বই দুটিই লিখতেন, তা-ও তাকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করতে হতো বাংলা সাহিত্যের।
‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসের সমাপ্তি হয় এভাবে-
‘মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে। একঘেয়ে কান্না সুরের মতো সে শব্দ। আমি কান পেতে শুনি। বাতাসে জাম গাছের পাতায় সর সর শব্দ হয়। সব মিলিয়ে হৃদয় হা হা করে ওঠে। আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় কী বিপুল বিষণ্নতাই না অনুভব করি। জানালার ওপাশে অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে।
একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবছি।’
প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, আমরা আপনাকে ভুলি নাই।
লেখক: প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।