মফিজুর রহমান পলাশ : চেকপোস্ট ডিউটি চলছিল। প্রখর রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে করতে ততক্ষণে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি। এমন সময় একজন নারী শরবতের একটি বোতল নিয়ে এসে রাস্তার ওপারে এক মাঝবয়সী নারীকে দেখিয়ে বললেন, উনি আপনাদের জন্য পাঠিয়েছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ও আমার সহকর্মীরা হতবাক। পুলিশের জন্য কেউ খাবার-পানীয় পাঠায়? আমার সাথে ডিউটিতে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে ইঙ্গিত করলাম শরবতের বোতল গ্রহণ করার জন্য। ব্যাপারটা আমার কাছে এতোটাই আকস্মিক ও অভাবনীয় ছিলো যে আমি হতভম্ব হয়ে বাসাটার দিকে তাকালাম। দোতলার বারান্দায় গ্রিলের ফাঁক থেকে অপলক দুটি চোখে আমাদের দিকে চেয়ে আছেন। মায়ের বয়সী ওই নারীকে দেখে হুঁশ ফিরে এলো। বিপর্যয়ের এই সময়টাতে রোদের মধ্যে সকাল থেকেই তার বাসার সামনে কাজ করছিলাম দেখে উনার পক্ষ থেকে এই অসামান্য উপহার। কিন্তু আমি নিজের হাতে না নেয়ায় হয়তো উনি দ্বিধান্বিত যে আমরা শরবতটা সানন্দে গ্রহণ করবো কি-না! নিজের মধ্যে খানিকটা অপরাধবোধ তৈরি হলো। বোতলটি হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক গিলে ফেললাম আর হাতের ইশারায় তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। মুখে একটি তৃপ্তির হাসি দিয়ে ‘মা’ ভেতরে চলে গেলেন।
পথে-ঘাটে, রোদ-বৃষ্টিতে, সারাবছর কাজ করে যাই। মাস শেষে বেতন-ভাতা তুলি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে রাস্তার ওপারে দোতলা বারান্দায় মিষ্টি হাসির সেই অচেনা মায়ের এই ভালোবাসা আমার ছোট্ট চাকরি জীবনের সবচাইতে বড় স্বীকৃতি। রাস্তায় ডিউটি করতে গিয়ে অচেনা অজানা এক মায়ের হাতে তৈরি শরবতের চেয়ে সুশীতল ও সুমিষ্ট উপহার এক জীবনে সত্যিই অতুলনীয়। আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি মানুষকে এই গল্প বলে বেড়াবো গর্বিত মুখে,পরম শ্রদ্ধায়,গভীর তৃপ্তিতে।
অনেক সমালোচনা, অনেক কটূক্তি শুনে পুলিশের কান ঝালপালা হয়ে গেছে। সারাক্ষণ মারামারি, হাঙ্গামা, খুন, লাশ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে, মর্গ-হাসপাতাল-আদালত দৌড়াতে দৌড়াতে পুলিশের মেজাজ থাকে সপ্তমে। তখন একটা ভালো জিনিসকেও আর ভালো লাগে না। বাংলাদেশ পুলিশের মতো এত চাপ নিয়ে পৃথিবীতে আর কোনো পুলিশ বাহিনী কাজ করে কি-না জানা নেই।
বাংলাদেশ পুলিশের অতীত সুখকর ছিলো না। কিন্তু এই পুলিশ সেদিনই আপনার পুলিশ হয়েছে যেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চের কালো রাতে ঢাকার নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলে পড়ে। আপনি কি জানেন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হায়েনার বিরুদ্ধে প্রথম পাল্টা আঘাত আসে আপনার এই পুলিশের বন্দুক থেকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ডিআইজি, এসপিসহ প্রায় ১৫০০ সদস্য শাহাদাতবরণ করেন। বিষয়টি একই সাথে গর্বের ও আনন্দের। কিন্তু তাদের একজনও বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাননি!
যুগ যুগ ধরে পুলিশকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে পুলিশকে নিয়ে। এতে প্রকৃত সাহসী ও মেধাবী ছেলেরা পুলিশে আসতে অনীহা প্রকাশ করতেন, কিন্তু সময় বদলে গেছে। এখন দেশের মেধাবীদের কাছে বাংলাদেশ পুলিশ একটি কাঙ্ক্ষিত নাম। পুলিশের এএসপি, সাব-ইন্সপেক্টর, সার্জেন্ট প্রভৃতি পদে প্রতিবছর প্রায় নিয়মিতভাবে নিয়োগ করা হচ্ছে। এসব পদে যোগ দিচ্ছেন ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শীর্ষ পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গ্রাজুয়েটরা। এমন হাজার হাজার মেধাবী ও সাহসী তরুণের কর্মস্থল যখন বাংলাদেশ পুলিশ, তখন আপনি এই পুলিশে আস্থা রাখতেই পারেন।
বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সেরা পুলিশ হলো লন্ডন পুলিশ। কথিত আছে সেখানকার পুলিশের সেবা এতো আন্তরিক ও বিশ্বস্ত যে পড়ার টেবিলে কোনো বাচ্চা তার বই খুঁজে না পেলে সবার আগে সে পুলিশের জরুরি নম্বরে কল করে বই খুঁজে দেয়ার জন্য!
বাংলাদেশ পুলিশও আজ অনেকটা লন্ডন পুলিশের ভূমিকায়। বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা পৃথিবীকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। করোনায় মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে দেড় লাখ পার হয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। মানুষ করোনায় নিজের অসুস্থ মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে যাচ্ছে, মৃতদেহের সৎকারে আপনজনেরাও অংশ নিচ্ছে না। কিন্তু পুলিশ প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে বীরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে এসব মানুষের জন্য। ইতোমধ্যে দেশের নানা জেলায় পুলিশের অনেক সদস্য ও কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আপনার জীবন বাঁচাতে পুলিশের জীবন আজ সংকটে, তবু তৃপ্তি এখানেই যে মানুষের জন্য পুলিশ তার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করে যাচ্ছে।
এই পুলিশ তাদের বেতন ভাতা থেকে ২০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। এখান থেকে সাহায্য পাবেন দেশের অসহায় মানুষেরা। আজ ফোন করলেই পুলিশ মানুষের বাজার করে দিয়ে আসছে ঘরে ঘরে। মানুষকে ঘরে থাকতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। এছাড়া রোগীকে হসপিটালে পাঠানো থেকে শুরু করে মানুষকে কাউন্সেলিং করা, গানে গানে কোয়ারেন্টাইনে থাকা লোকদের সঙ্গ দেয়া, জনসাধারণের মাঝে মাস্ক-স্যানিটাইজার বিতরণ, মধ্যবিত্তের ঘরে গোপনে খাবার দিয়ে আসাসহ করোনা চিকিৎসার সাথে নিয়োজিত চিকিৎসক ও কর্মীদের নিরাপত্তা প্রদান, কবরস্থানের জন্য জায়গা দেয়া, কবর খোঁড়া, লাশ কাঁধে নিয়ে গোরস্থানে যাওয়া, কিশোরদের হাতে হাতে বই তুলে দিয়ে তাদের ঘরমুখী করার কাজ নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের দুই লক্ষাধিক সদস্য।
এই পাল্টে যাওয়া পুলিশ সারাদেশে নিজেদের রেশনের চাল-ডাল-তেল-চিনি অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে অভাবী মানুষের মাঝে। ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কেনা খাদ্যসামগ্রী। আমার বিশ্বাস আপনি এমন পুলিশই চেয়েছেন, লন্ডন পুলিশের মতো।
আপনি হটলাইন ৯৯৯-এ একটা কল দিলেই পুলিশ পৌঁছে যাচ্ছে আপনার দোরগোড়ায়। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, আপনি গভীর রাতে আপনার বাচ্চার জন্য দুধ চেয়ে ফোন করলে হয়তো পুলিশ দুধের প্যাকেট হাতে পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়। এই পরিবর্তিত পুলিশের জন্য পথের অচেনা অজানা মায়েদের তাই অকৃত্রিম ভালোবাসা।
বাংলার অলি-গলি-রাজপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন হাজারো মায়ের মুখে এক টুকরো হাসি আমাদের চলার পথে প্রেরণা যোগায়, আমাদের আবেগ্লাপুত করে। ভালো থাকুন মায়েরা, নিরাপদে থাকুক প্রিয় জন্মভূমি। আপনার যখন বন্ধু নেই, বন্ধু তখন বাংলাদেশ পুলিশ।
লেখক
সহকারী পুলিশ কমিশনার
মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ, ডিএমপি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।