সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন আপনার ছোট্ট সোনামণির নাক দিয়ে পানি ঝরছে, গলাটা একটু খুড়খুড় করছে। হাতটা কপালে রাখতেই টের পেলেন জ্বর এসেছে। এই দৃশ্য কি খুব অচেনা? বাংলাদেশের ঘরে ঘরে, বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে, অসুস্থ শিশুর কান্না যেন এক করুণ সঙ্গীত। কিন্তু ভাবুন তো, এমনও তো হতে পারত যে আপনার শিশুটি সারাবছরই প্রাণবন্ত, খেলাধুলায় মত্ত, স্কুলে উপস্থিতি নিখুঁত? বাচ্চাদের ইমিউনিটি বুস্টার খাবার – এই শব্দগুচ্ছটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই সুস্থ, প্রাণচঞ্চল শিশুর রহস্য। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমই হলো শিশুর শরীরের সেই অদৃশ্য বর্ম, যে বর্ম ভেঙে রোগজীবাণু সহজে আক্রমণ করতে পারে না। আর এই বর্মকে অজেয় করে তোলার মূল উপকরণ মেলে আমাদেরই রান্নাঘরে, বাজারে, প্রতিদিনের খাবারের প্লেটে। শুধু জানতে হবে কোন খাবারগুলো প্রকৃতই শিশুর জন্য ‘ইমিউনিটি সুপারহিরো’, আর কীভাবে সেগুলোকে তার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় আনন্দের সঙ্গে জায়গা করে দিতে হয়। এটা কোনো জাদুর কৌশল নয়, এটা হলো প্রকৃতির বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোর কৌশল।
বাচ্চাদের ইমিউনিটি বুস্টার খাবার কেন অপরিহার্য? (বিজ্ঞান ও বাস্তবতা)
শিশুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো পুরোপুরি বিকশিত নয়। এটি ধীরে ধীরে পরিণত হয়, জীবাণুর সংস্পর্শে এসে শিখে এবং শক্তিশালী হয়। এই বিকাশের সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চাদের ইমিউনিটি বুস্টার খাবার সরবরাহ করে সেই সমস্ত অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান যা ইমিউন কোষ গঠন, তাদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে সাহায্য করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বারবারই জোর দিয়েছে যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু ও অসুস্থতার একটি অন্যতম প্রধান কারণ অপুষ্টি ও সংক্রামক রোগ, যার মূলে দুর্বল ইমিউনিটি। বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুরা প্রায়ই ভিটামিন এ, জিঙ্ক, আয়রন ও প্রোটিনের ঘাটতিতে ভোগে, যা তাদের সংক্রমণের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল করে তোলে। এই ঘাটতি পূরণে প্রকৃতিক খাদ্যই হলো প্রথম ও প্রধান সমাধান। এগুলো কৃত্রিম সাপ্লিমেন্টের চেয়ে সহজলভ্য, সাশ্রয়ী, এবং শরীরের জন্য অনেক বেশি কার্যকরভাবে শোষিত ও কাজ করে।
প্রকৃতির ইমিউনিটি পাওয়ার হাউস: কোন খাবারগুলো শিশুর জন্য অপরিহার্য?
এখন আসুন সেই গুপ্তধনের সন্ধানে যাই। কোন খাবারগুলো শিশুর ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করার জন্য প্রকৃতই ‘সুপারস্টার’?
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার (প্রোটিন, ভিটামিন এ, ডি, জিঙ্কের উৎস):
- কেন দরকার: প্রোটিন হলো অ্যান্টিবডি ও ইমিউন কোষ গঠনের মূল ভিত্তি। ভিটামিন ডি ইমিউন কোষের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভিটামিন এ শ্লৈষ্মিক ঝিল্লিকে (যা নাক, গলা, ফুসফুসের প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর) সুস্থ রাখে। জিঙ্ক ইমিউন কোষের বৃদ্ধি ও কার্যকারিতায় সাহায্য করে।
- বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে কী খাওয়াবেন: গরুর দুধ, দই (প্রোবায়োটিকের দুর্দান্ত উৎস, যা অন্ত্রের সুস্থ ব্যাকটেরিয়া বাড়ায় – আর অন্ত্রই হলো ইমিউনিটির ৭০% কেন্দ্র!), পনির, ছানা। দইয়ে চিনি কম দিয়ে তাজা ফল মিশিয়ে দিলে শিশুরা খুব পছন্দ করবে। খাঁটি ঘি (পরিমিত পরিমাণে) ভিটামিন এ, ডি, ই, কে শোষণে সাহায্য করে।
- বিশেষজ্ঞ মন্তব্য: বাংলাদেশের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সৈয়দা ফাতেমা জোহরা (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) বলেন, “দুই বছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার হিসাবে গরুর দুধ বা ফরমুলা দুধ দিতে হবে। দই শিশুর হজমশক্তি ও রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে ডায়রিয়ার পর দ্রুত অন্ত্রের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে।
রঙিন ফল ও শাকসবজি (ভিটামিন সি, এ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইবারের ভাণ্ডার):
- কেন দরকার: ভিটামিন সি শ্বেত রক্তকণিকা উৎপাদন বাড়ায় এবং তাদের জীবাণু ধ্বংসের ক্ষমতা শক্তিশালী করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (বিটা-ক্যারোটিন, লাইকোপিন, ফ্ল্যাভোনয়েডস ইত্যাদি) ফ্রি র্যাডিক্যাল নামক ক্ষতিকর অণুগুলো থেকে শরীরের কোষ, বিশেষ করে ইমিউন কোষকে রক্ষা করে। ফাইবার অন্ত্রের সুস্থ ব্যাকটেরিয়াকে খাওয়ায়, যা ইমিউনিটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে কী খাওয়াবেন (ঋতুভিত্তিক):
- ভিটামিন সি: আমলকী (সারা বছর), কামরাঙ্গা, পেয়ারা, লেবু (কাগজি, এলাচি, জাম্বুরা), আম (গ্রীষ্ম), টমেটো, কাঁচা মরিচ (পরিমাণে কম), পেঁপে, আনারস, স্ট্রবেরি (শীত), বাতাবি লেবু (শীত)।
- ভিটামিন এ/বিটা-ক্যারোটিন: গাজর, মিষ্টি আলু (রাঙা আলু), কুমড়া, লাউ, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, লালশাক, পালংশাক, কাঁকরোল, টমেটো, আম, পেঁপে।
- অন্যান্য শক্তিশালী সবজি: ব্রকলি (যদি পাওয়া যায়), ফুলকপি, বাধাকপি – এগুলোতে ভিটামিন সি, কে, ফোলেট ও সালফোরাফেন নামক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে।
- কিভাবে পরিবেশন করবেন: ফল কেটে টুকরো করে দিন, ফলের সালাদ বানান, ফলের রস (চিনি ছাড়া, পরিমিত), সবজি স্যুপ, সবজি খিচুড়ি, সবজি ভাজি, পরোটা/রুটির সাথে সবজি ভর্তা। রঙিন খাবার প্লেট শিশুকে আকর্ষণ করে।
ডাল, বাদাম, বীজ ও গোটা শস্য (প্রোটিন, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, আয়রন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ফাইবার):
- কেন দরকার: জিঙ্ক ইমিউন কোষের উন্নয়ন ও যোগাযোগের জন্য অত্যাবশ্যক এবং প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। সেলেনিয়াম একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। আয়রন অক্সিজেন পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয়, যা ইমিউন কোষের শক্তি জোগায়। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স শক্তি উৎপাদন ও ইমিউন কোষের কার্যকারিতায় ভূমিকা রাখে। ফাইবার অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি।
- বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে কী খাওয়াবেন:
- ডাল/মসুর: মুগ ডাল, মসুর ডাল (খোসাসহ), ছোলার ডাল, মটর ডাল – প্রোটিন ও জিঙ্কের ভালো উৎস। খিচুড়ি করে ডাল-ভাত-সবজি একসাথে দিলে পুষ্টি পরিপূর্ণ হয়।
- বাদাম ও বীজ: চিনাবাদাম (গুঁড়ো করে বা পেস্ট করে), তিল (বুড়ি/তিলের ডালনা, তিলের লাড্ডু), সূর্যমুখী বীজ, কুমড়ার বীচি (শুকনো ভেজে গুঁড়ো করে দই বা স্যুপে মিশিয়ে)। সতর্কতা: ৫ বছরের কম বয়সী শিশুকে গোটা বাদাম বা বড় বীজ দেবেন না, শ্বাসনালীতে আটকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। পেস্ট বা গুঁড়ো করে দিন।
- গোটা শস্য: লাল চালের ভাত (চালের ছাতুর ভাত), ওটস (খিচুড়ি বা সুজি হিসেবে), গমের আটার রুটি/পরোটা (যতটা সম্ভব লাল আটা ব্যবহার করুন), ভুট্টার আটা, বার্লি।
- মাছ, মাংস ও ডিম (উচ্চমানের প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ডি, ওমেগা-৩):
- কেন দরকার: প্রাণীজ প্রোটিনে সমস্ত প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। আয়রন (হিম আয়রন) সহজে শোষিত হয়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছে) প্রদাহ কমাতে এবং ইমিউন কোষের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি১২ স্নায়ুতন্ত্র ও রক্তকণিকার জন্য জরুরি।
- বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে কী খাওয়াবেন:
- মাছ: ছোট মাছ (মলা, ঢেলা, পুঁটি, চাঁদা) – ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর দুর্দান্ত উৎস (হাঁড়সহ খাওয়ালে)। ইলিশ, রুই, কাতলা, ট্যাংরা, সামুদ্রিক মাছ (যদি পাওয়া যায়) – ওমেগা-৩ ও প্রোটিনের ভালো উৎস। সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন মাছ দেওয়া উচিত।
- মাংস: মুরগির মাংস (ব্রেস্ট বা বাচ্চার মাংস), গরুর কলিজা (লিভার) – ভিটামিন এ, আয়রন, জিঙ্কের ভাণ্ডার (সপ্তাহে একবার পরিমিত পরিমাণে)। ডিম – সস্তা ও পুষ্টিগুণে ভরপুর ‘সুপারফুড’। প্রতিদিন ১ টি সিদ্ধ বা অমলেট করে দিন।
- সতর্কতা: চর্বিযুক্ত মাংস ও প্রক্রিয়াজাত মাংস (সসেজ, হটডগ, নাগেটস) এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত তেলে ভাজবেন না।
বয়স অনুযায়ী শিশুর ইমিউনিটি বুস্টার খাবারের পরিকল্পনা (ব্যবহারিক গাইড)
শিশুর বয়সভেদে খাবারের ধরন, পরিমাণ ও বাছাইয়ের পদ্ধতি ভিন্ন হয়। বাংলাদেশের ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিস (NNS) এবং ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথ নিউট্রিশন (IPHN) শিশু পুষ্টির জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন দিয়েছে:
- ৬ মাস পর্যন্ত: শুধুমাত্র বুকের দুধ। এটিই নবজাতকের জন্য পরম ইমিউনিটি বুস্টার, যাতে মায়ের অ্যান্টিবডি সরাসরি শিশুকে পৌঁছায়। বাচ্চাদের ইমিউনিটি বুস্টার খাবার বলতে এই সময়ে শুধু মায়ের বুকের দুধই।
- ৬ মাস থেকে ১ বছর: বুকের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার শুরু।
- শুরু করুন একবারে (৬ মাসে), ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তিন বেলা (৮-৯ মাস) ও পরে তিন বেলা + ১-২ টি নাস্তা (১০-১২ মাস) করুন।
- প্রথম খাবার: পাতলা ডালের ঝোল বা ভাতের মাড়, ম্যাশ করা কলা/আলু/গাজর। ধীরে ধীরে ঘনত্ব বাড়ান।
- পরবর্তীতে যোগ করুন: ভালোভাবে সিদ্ধ ও ম্যাশ করা ডাল-ভাত-সবজির খিচুড়ি (তেল/ঘি মিশিয়ে), ম্যাশ করা ফল (পাকা পেঁপে, আম), ডিমের কুসুম (সিদ্ধ, অল্প থেকে শুরু), মাছের কিমা/ছোট মাছ ভালোভাবে সিদ্ধ করে ম্যাশ করা, মুরগির মাংস ব্লেন্ড করা।
- জিঙ্ক ও আয়রন: ডাল, মাছ, মাংস, ডিমের কুসুম নিয়মিত দিতে হবে। পাতাকপি, ব্রকলির মতো আয়রনসমৃদ্ধ সবজি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার (টমেটো, লেবুর রস) এর সাথে দিন, শোষণ বাড়বে।
- পরিবেশনা: খাবার যেন খুব নরম ও সহজে গিলতে পারে এমন হয়। নতুন খাবার একবারে এক ধরনের ও অল্প পরিমাণে চালু করুন, অ্যালার্জি লক্ষ্য করুন।
- ১ বছর থেকে ৫ বছর: বিভিন্ন ধরনের পরিবারিক খাবারের সাথে অভ্যস্ত করা।
- বুকের দুধ চালু রাখা ভালো, তবে ধীরে ধীরে গরুর দুধ/দুধজাত খাবার প্রধান দুগ্ধ উৎস হতে পারে।
- পুষ্টিকর খাবার: পরিবারের সবার সাথে বসে ভাত/রুটি, ডাল, সবজি (রান্না ও কাঁচা সালাদ), মাছ/মাংস/ডিম, ফল, দুধ/দই খাওয়ান।
- মুখরোচক করে তোলা: খাবারে রং ও টেক্সচারের ভিন্নতা আনুন (নরম সবজির টুকরো, ফল কাটা, দই ফলের সাথে)। ছোট ছোট আকর্ষণীয় টুকরো করুন।
- জাঙ্ক ফুড সীমিত করা: প্যাকেটজাত জুস, কোমল পানীয়, চিপস, অতিরিক্ত মিষ্টি ও ভাজাপোড়া খাবার ইমিউনিটির জন্য ক্ষতিকর। এগুলো দ্রুত শর্করা ও অস্বাস্থ্যকর চর্বি যোগ করে, পুষ্টিকর খাবারের জায়গা দখল করে।
- জলের অভ্যাস: পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করান। ডিহাইড্রেশন ইমিউনিটিকে দুর্বল করে।
- ৫ বছর ও তার উপরে: সুষম ও নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস গঠন।
- প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় নিশ্চিত করুন: ফল (২-৩ সার্ভিং), শাকসবজি (৩-৫ সার্ভিং, যার অর্ধেক কাঁচা বা হালকা সেদ্ধ), গোটা শস্য (ভাত/রুটি/ওটস), প্রোটিন (ডাল/মাছ/মাংস/ডিম), দুধ/দই (২-৩ সার্ভিং)।
- স্ন্যাক্স হিসাবে: ফল, দই, বাদাম বাটার (চিনাবাদাম) স্যান্ডউইচ, ছোলা ভাজা, মুড়ি, ঘরে বানানো পিঠা-পায়েশ (পরিমিত মিষ্টি) দিন।
- খেলাধুলা ও ঘুম: ইমিউনিটির জন্য পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপ (কমপক্ষে ১ ঘন্টা) ও গভীর ঘুম (বয়স অনুযায়ী ৯-১২ ঘন্টা) অপরিহার্য।
শুধু খাবারই নয়: ইমিউনিটি বুস্টিং এর অন্যান্য স্তম্ভ
বাচ্চাদের ইমিউনিটি বুস্টার খাবার শক্তিশালী করার জন্য খাদ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলেও, আরও কিছু বিষয় সমানভাবে প্রয়োজনীয়:
- টিকাকরণ (Vaccination): এটি ইমিউন সিস্টেমকে নির্দিষ্ট মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয় ও স্মৃতিশক্তি দেয়। বাংলাদেশের Expanded Program on Immunization (EPI)-এর সকল টিকা সময়মতো দিতে হবে। এটি সরাসরি ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করার সবচেয়ে কার্যকর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের EPI শিডিউল দেখুন।
- স্বাস্থ্যকর অন্ত্র (Gut Health): অন্ত্রে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ উপকারী ব্যাকটেরিয়া (গাট মাইক্রোবায়োম) ইমিউনিটির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। প্রোবায়োটিক (দই, ছাঁচহীন পনির, ফার্মেন্টেড খাবার – যেমন: ডোসা/ইডলির বাটার, যদিও শিশুদের জন্য অল্প) এবং প্রিবায়োটিক ফাইবার (শাকসবজি, ফল, গোটা শস্য, ডাল, বাদাম, বীজ) এই উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের খাদ্য ও সংখ্যা বাড়ায়।
- পর্যাপ্ত ঘুম: ঘুমের সময় শরীর সাইটোকাইনস নামক প্রোটিন তৈরি করে, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং ইমিউন কোষের কার্যকারিতায় সাহায্য করে। ঘুমের অভাব এই প্রোটিন উৎপাদন কমিয়ে দেয়।
- নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ: মাঝারি ধরনের ব্যায়াম (খেলাধুলা, দৌড়াদৌড়ি, সাইকেল চালানো) রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, যা ইমিউন কোষগুলোকে শরীরে অবাধে চলাচল করতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত ব্যায়াম আবার বিপরীত প্রভাবও ফেলতে পারে।
- স্ট্রেস কমানো: দীর্ঘস্থায়ী চাপ কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়ায়, যা ইমিউনিটিকে দমন করতে পারে। শিশুকে নিরাপদ, প্রেমপূর্ণ ও আনন্দময় পরিবেশ দিন। তার আবেগের কথা শুনুন।
- নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন: বিশুদ্ধ পানি পান করা এবং সঠিক স্যানিটেশন অভ্যাস (সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, নিরাপদ পায়খানা) শিশুকে রোগজীবাণুর সংস্পর্শে আসা থেকে রক্ষা করে, ইমিউন সিস্টেমের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ কমায়। ইউনিসেফ বাংলাদেশ – ওয়াশ কর্মসূচি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়।
মায়েদের জন্য ব্যবহারিক টিপস: কিভাবে বাছাই করবেন ও পরিবেশন করবেন
- স্থানীয় ও ঋতুভিত্তিক খাবার বেছে নিন: এগুলো সাধারণত তাজা, সস্তা এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর থাকে। গ্রীষ্মে তরমুজ, বর্ষায় কাঁচা আম, শীতে বিভিন্ন শাক ও কমলা-মাল্টা জাতীয় ফল।
- রঙিন প্লেট: লাল (টমেটো, পেঁপে), কমলা (গাজর, মিষ্টি কুমড়া), হলুদ (মরিচ, ভুট্টা), সবুজ (পালংশাক, বরবটি, শসা), সাদা (ফুলকপি, মুলা), বেগুনি (বেগুন, বাঁধাকপি) – প্রতিদিনের খাবারে যত বেশি রঙ থাকবে, তত বেশি পুষ্টি পাবে।
- কম রান্না, বেশি পুষ্টি: সবজি অতিরিক্ত সিদ্ধ করলে বা ভাজলে পুষ্টি নষ্ট হয়। বাষ্পে সিদ্ধ করা, হালকা স্টার ফ্রাই করা বা কাঁচা সালাদ দেওয়া ভালো।
- নতুন স্বাদে অভ্যস্ত করুন: শিশু নতুন খাবার প্রথম বার প্রত্যাখ্যান করলেও হাল ছাড়বেন না। ধৈর্য্য ধরে একই খাবার ১০-১৫ বার বিভিন্নভাবে পরিবেশন করুন। নিজে খেয়ে দেখান।
- রান্নায় শিশুকে যুক্ত করুন: ছোট কাজ (সবজি ধোয়া, মেশানো) দিলে খাবার সম্পর্কে তার আগ্রহ বাড়ে।
- জোর করবেন না, উৎসাহ দিন: খাবারের সময় আনন্দময় হোক। জোর করে খাওয়ালে খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি হতে পারে। ছোট ছোট অংশ বারবার দিন।
- আদর্শ তৈরি করুন: শিশুরা যা দেখে তাই শেখে। আপনি যদি রঙিন শাকসবজি, ফল ও স্বাস্থ্যকর খাবার খান, আপনার শিশুও তাই করতে উৎসাহিত হবে।
জেনে রাখুন (FAQs):
Q: শিশুর ইমিউনিটি দুর্বল বলে কখন সন্দেহ করব?
A: যদি আপনার শিশু খুব ঘন ঘন সর্দি-কাশি-জ্বরে ভোগে (বছরে ৮-১০ বার বা তার বেশি), সাধারণ সর্দি-কাশিও সহজে সেরে না ওঠে (১০-১৪ দিনের বেশি থাকে), বারবার কানে ইনফেকশন, ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়া হয়, ঘন ঘন ডায়রিয়া বা পেটের সমস্যা দেখা দেয়, অ্যান্টিবায়োটিক খেলেও বারবার সংক্রমণ হয়, বা ওজন বৃদ্ধি ঠিকমতো না হয় – তাহলে ইমিউনিটি দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।Q: বাচ্চাদের ইমিউনিটি বুস্টার সাপ্লিমেন্ট দরকার কি?
A: সাধারণভাবে, একটি সুষম ও বৈচিত্র্যময় খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন ও মিনারেল পাওয়া সম্ভব। তবে কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট দেওয়া যেতে পারে, যেমন: ভিটামিন ডি (বিশেষ করে রোদে কম থাকলে), আয়রন (যদি রক্তস্বল্পতা ধরা পড়ে), জিঙ্ক (গুরুতর ডায়রিয়ার সময় বা ঘাটতি থাকলে), বা প্রোবায়োটিক (অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পর)। কোনোভাবেই নিজে থেকে বা ফার্মেসি থেকে কিনে শিশুকে ইমিউনিটি বুস্টার সিরাপ/ট্যাবলেট দেবেন না। অতিরিক্ত ভিটামিন (বিশেষ করে এ, ডি, ই, কে) শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।Q: কোন খাবারগুলো শিশুর ইমিউনিটির জন্য ক্ষতিকর?
A: অতিরিক্ত চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার (ক্যান্ডি, চকলেট, প্যাকেট জুস, কোমল পানীয়, মিষ্টি) শ্বেত রক্তকণিকার জীবাণু ধ্বংসের ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। প্রক্রিয়াজাত খাবার (প্যাকেট চিপস, ইনস্ট্যান্ট নুডুলস, প্রিজারভেটিভযুক্ত খাবার), অতিরিক্ত লবণ ও অস্বাস্থ্যকর চর্বি (ভাজাপোড়া, ফাস্ট ফুড, বেকারি আইটেমে ট্রান্স ফ্যাট) প্রদাহ বাড়ায় এবং সামগ্রিক পুষ্টির মান কমায়। এই খাবারগুলো শিশুর প্লেটে নিয়মিত স্থান পেলে প্রকৃত ইমিউনিটি বুস্টার খাবারগুলোর জায়গা কমে যায়।Q: বাচ্চাকে ফল-শাকসবজি খাওয়াতে চাই না, কী করব?
A: ধৈর্য্য ধরুন এবং কৌশলী হন। ফল কেটে আকর্ষণীয় আকার দিন (তারকা, চাঁদ)। ফলের সাথে দই মিশিয়ে স্মুদি বানান। সবজি দিয়ে সুস্বাদু স্যুপ, কাটলেট বা পরোটা বানান। খিচুড়িতে নানান রঙের সবজি কুচি করে দিন। ছোট ছোট টুকরো করে সালাদে মিশিয়ে দিন। নিজে উৎসাহ নিয়ে খান। বাচ্চাকে সাথে নিয়ে বাজার করুন, তাকে সবজি বেছে নিতে দিন। বাগান করলে তাকে চাষ করতে দিন। জোর করবেন না, বরং অল্প অল্প করে নিয়মিত পরিবেশন করুন।- Q: গ্রীষ্ম বা শীতকালে বিশেষ কী খাওয়ানো উচিত?
A: গ্রীষ্মে: পানিযুক্ত ফল (তরমুজ, বাঙ্গি, শসা, আনারস) বেশি দিন, হালকা ও সহজপাচ্য খাবার (ডাল, ছোলার ডালের স্যুপ, দই-চিড়া), নারিকেল পানি। শীতে: ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল (কমলা, মাল্টা, বাতাবি লেবু, স্ট্রবেরি), গাজর, মিষ্টি আলু, গুড় (পরিমিত), বিভিন্ন শাক (পালং, লালশাক), গরম স্যুপ ও হালুয়া। সব ঋতুতেই বিশুদ্ধ পানি পান নিশ্চিত করুন।
এই পথচলা সহজ নয়। ক্লান্তি আসবে, হতাশাও হয়তো কড়া নাড়বে। কিন্তু প্রতিদিন একটু একটু করে, এক টুকরো ফল, এক মুঠো শাক, এক বাটি দই যোগ করতে থাকুন আপনার শিশুর প্লেটে। মনে রাখবেন, আজ আপনি যে পুষ্টির বীজ বপন করছেন, তা ভবিষ্যতে তার দেহ-মনকে এক অজেয় দুর্গে পরিণত করবে। প্রকৃতির এই বাচ্চাদের ইমিউনিটি বুস্টার খাবার-ই হলো সেই জাদুর চাবিকাঠি, যা খুলে দিতে পারে আপনার শিশুর সুস্থ, প্রাণবন্ত ও ভরপুর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দরজা। শুরু করুন আজই। আপনার শিশুর উজ্জ্বল, রোগমুক্ত আগামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব আপনার হাতেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।