রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে: গাইবান্ধাসহ উত্তরের সব জেলায় শীত যত জেঁকে বসছে, ততই ক্রেতার ভীড় বাড়ছে পিঠাপুলির মৌসুমী দোকানে। জেলা সদর থেকে শুরু করে উপজেলা শহরের অলিগলির দোকানে দোকানে এখন পিঠার পসরা।
গাইবান্ধা জেলা পরিষদের ঠিক সামনেই পিঠার পসরা নিয়ে বসেছেন মিলন মণ্ডল। অস্থায়ী দোকানের কয়েকটি চুলায় পিঠা বানাচ্ছিলেন তিনি। কোনো চুলার ওপর বসানো পাত্র থেকে ভাঁপ উঠছে গরম গরম ভাঁপা পিঠার। কোনো চুলায় তেঁতে উঠছে চিতই। গরমাগরম ক্রেতার হাত হয়ে সেগুলো চালান হয়ে যাচ্ছে পেটে। ভীড় সামলাতে ছেলেকেও সাহায্যকারী হিসেবে এনেছেন তিনি।
মিলন বলেন, কয়েক বছর ধরে শীত আসলেই পিঠার মৌসুমি দোকান করেন তিনি। বছরের অন্য সময় নানা কাজ করেন। এবারও শীতের শুরুতেই পিঠার দোকান দিয়েছেন। শীত যত বাড়ছে, ক্রেতার ভীড়ও তত বাড়ছে।
জেলা পরিষদ মোড় গাইবান্ধা শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। এখানে বিভিন্ন এলাকার যাত্রীদের ভীড় থাকে। থাকে সেসব যাত্রীদের বহনকারী ইজিবাইক ও অটোরিকশার চালকদেরও সরব উপস্থিতি।
ইজিবাইকের চালক মহব্বত হাওলাদার পিঠা কিনছিলেন মিলনের দোকান থেকে। মহব্বত বলেন, জেলা পরিষদ মোড় থেকে যাত্রী নিয়ে গোবিন্দগঞ্জের নাকাইহাট সড়কে নিয়মিত যাতায়াত করেন তিনি। অনেক সময় যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তখন তাঁর মতো অনেক চালক ও যাত্রী মিলনের দোকানের পিঠা কেনেন। শীতে পিঠা ভালো লাগে।
গাইবান্ধা শহরে পিঠাপুলির দোকান সবচেয়ে বেশি গোরস্থান সড়কে আসাদুজ্জামান মার্কেটের পাশে। এখানে দোকান করেন মো: জুয়েল, মো: আমজাদ ও মেহেদী হাসান। সবারই অস্থায়ী দোকান। এঁদের বাড়ি একই এলাকায়। সদর উপজেলার জগৎরায় গোপালপুর গ্রামে।
এখানে মেহেদী ভাঁপা বিক্রি করেন। তাঁর ভাঁপার বেশ নামডাক শহরে। তিনি জানান, তিনি বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পিঠা বেচেন। এ সময়ের মধ্যে প্রথম দিকে প্রায় ১২০-১৩০টি পিঠা বিক্রি হতো। এতে তাঁর প্রায় ১০ কেজি আতপ চালের আটা যেত। এর সঙ্গে গুড় ও নারকেল লাগে। এখন বেচাবিক্রি ১৫০ ছাড়িয়েছে।
মেহেদীর ভাঁপার সুনাম করলেন ক্রেতা শহিদুর রহমান ও তাঁর সঙ্গীরা। তিনি বললেন, তিনি গাইবান্ধা সরকারি কলেজে স্নাতকে পড়েন। মেহেদীর ভাঁপা ভালো হয়। এ জন্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে খেতে এসেছেন।
জুয়েল ও আমজাদ চিতই পিঠা বিক্রি করেন। তাঁরা জানান, কয়েক বছর আগে তাঁদের মধ্যে আমজাদ প্রথমে শহরে পিঠা বেচা শুরু করেন। আমজাদের দেখাদেখি অন্যরাও আস্তেধীরে শীতের মৌসুমে এ দোকান করা শুরু করেন।
এই দুই পিঠাবিক্রেতা বলেন, সর্ষেবাঁটা, কালিজিরা, শুঁটকি, আলু ধনিয়াপাতা ভর্তা দিয়ে চিতই বেচেন তাঁরা। শুরুতে বিক্রি কিছুটা কম হলেও ক্রমে বাড়ছে। দুজনই দিনে প্রায় ২৫০টি করে পিঠা বিক্রি করেন।
শহরের আদর্শপাড়ার রেলগেট এলাকায় ভাঁপা ও চিতই বিক্রি করেন মানিক মিয়া। তাঁর দোকানে পিঠার দাম কিছু কম। প্রতিটি ৫ টাকা করে।
মানিক বলেন, কিছুটা শহরতলী হওয়ায় এখানকার ক্রেতারা বেশি দাম দিয়ে পিঠা খেতে চান না। তিনিও ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কম টাকায়ই বিক্রি করেন।
শুধু এ জেলা শহর নয়, দেশের অন্যান্য এলাকার মতো এখানকার পলাশবাড়ী, সাদুল্যাপুর, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরসহ গ্রামেগঞ্জেও এখন পিঠার দোকানে ভীড় বাড়ছে।
পলাশবাড়ী শহরের সোনালী ব্যাংকের নিচে পিঠা বেচেন এক নারী দোকানী। তাঁর দোকানে ভাঁপা, চিতই ছাড়া পোয়া পিঠাও রয়েছে। পোয়া স্থানীয়ভাবে তেলভাজা পিঠা নামে পরিচিত। এখানে অনেকেই পোয়া খাচ্ছিলেন।
শাহবাজ কবির নামের এক ক্রেতা বললেন, তেলভাজা পিঠা সাধারণত এসব মৌসুমী দোকানে দেখা যায় না। বাড়িতেই বেশি বানানো হয়। হঠাৎ এখানে দেখে খাওয়ার আগ্রহ হলো তাঁর। ভালোই লাগছে।
একই উপজেলার প্রত্যন্ত কুমারগাড়ী গ্রামের ছাতিয়ানতলা বাজারেও পিঠা নিয়ে বসেছেন মনিফুল নামের এক নারী। তিনি বলেন, তিনি বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ব্যবসা করেন। আগে গ্রামের এ বাজারে পিঠার দোকান তেমন ছিল না। তিনি সাহস করে দিয়েছেন। বিক্রিবাট্টা খুব খারাপ নয়।
মনিফুলের দোকানের ক্রেতাদের মধ্যে ছিলেন পাশের গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ডুমুরগাছা গ্রামের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক শামছুল আলম। তিনি বলেন, শীতকালে পিঠাপুলি বানানো এ দেশের ঐতিহ্য। এখনো বাড়িতে এ চল থাকলেও কিছুটা কমেছে। সেই জায়গা দখল করেছে মৌসুমী এসব দোকান। এর মাধ্যমে বাড়ির বউদের কাজ যেমন কমেছে, তেমনি অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এমনকী গ্রামের অনেক নারীও এর মধ্য দিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
গাইবান্ধার মতো শীতের পিঠাপুলির চাহিদা বাড়ছে উত্তরের জেলা রংপুর, লালমনিরহাট,কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলাতেও। এসব জেলার গ্রামে শীতের সকাল মানেই পিঠা দিয়ে নাশতা। শীতের সকালে রোদে বসে নতুন চালের ধোঁয়া ওড়ানো গরম গরম পিঠাপুলি খাওয়ার মজাই আলাদা। আর বিকাল থেকে হাটবাজারে এবং শহরের মোড়ে বসে ভ্রাম্যমাণ শীতকালীন পিঠার দোকান। প্রতিদিন বিকাল থেকে এসব দোকানে পিঠার স্বাদ নিতে ভিড় করে নানা বয়সী মানুষ। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।