জুমবাংলা ডেস্ক : দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে অন্তত ৬০০ কোটি ডলার নয়ছয় হয়েছে। ডলারের বিপরীতে বর্তমান টাকার দর ধরে যা প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা (১ ডলার সমান ১২০ টাকা ধরে)। এর মধ্যে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দিতে কমিশন হিসেবে লুটপাট হয়েছে ৩০০ কোটি ডলার। আর বিদ্যুৎকেন্দ্র না চালিয়ে কেন্দ্রভাড়া ও অতিরিক্ত মুনাফা হিসেবে বেসরকারি খাত নিয়ে গেছে বাড়তি ৩০০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। গত রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ওই শ্বেতপত্র হস্তান্তর করেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ওই মাসের শেষ সপ্তাহে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়।
একদম রক্ষণশীল হিসাবেও প্রতিটি প্রকল্প থেকে ১০ শতাংশ টাকা কমিশন হিসেবে চলে গেছে। এ হিসাবে গত দেড় দশকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ করা ৩ হাজার কোটি ডলারের মধ্যে ৩০০ কোটি ডলার নয়ছয় হয়েছে
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: দুর্নীতির জন্য তৈরি কাঠামো’ শিরোনামের অধ্যায়ে বিদ্যুৎ খাতের লুটপাটের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০১০ সালে জারি করা হয় সবচেয়ে বিতর্কিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন। দফায় দফায় এটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩০ নভেম্বর অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ওই বিতর্কিত আইনটি বাতিল করেছে। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়ে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ আছে গত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। যদিও এসব লেনদেনের কোনো কাগজপত্র নেই। তবে একদম রক্ষণশীল হিসাবেও প্রতিটি প্রকল্প থেকে ১০ শতাংশ টাকা কমিশন হিসেবে চলে গেছে। এ হিসাবে গত দেড় দশকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ করা ৩ হাজার কোটি ডলারের মধ্যে ৩০০ কোটি ডলার নয়ছয় হয়েছে
চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও জ্বালানির অভাবে তা চালানো যায়নি। এর ফলে সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়নি। লোডশেডিংয়ে ভুগেছে সাধারণ মানুষ, শিল্পকারখানা। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকারের ভুল নীতি ও পরিকল্পনার জন্য বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে লুটপাট, অপচয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কেন্দ্রভাড়া নির্ধারিত থাকে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও এটি দিতে হয়, না করলেও এটি দিতে হয়। উৎপাদন না করে অলস বসিয়ে রেখে যে কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করা হয়, এটিকে অতিরিক্ত কেন্দ্রভাড়া বলা হয়ে থাকে। অতিরিক্ত কেন্দ্রভাড়া হিসাব করা কঠিন বলে মনে করছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। তাদের প্রতিবেদন বলছে, ২০১০-১১ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া হিসাবে। এ সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা গড়ে ৪২ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে। এতেই অদক্ষ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বোঝা যায়। তবে সব সীমাবদ্ধতা ধরেও ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে বিদ্যুৎকেন্দ্র। চুক্তির মেয়াদ শেষে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া রেখেই নবায়ন করা হয়েছে। এতে বাড়তি মুনাফার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে তাদের। সব মিলে অন্তত ৩০০ কোটি ডলার (৩৬ হাজার কোটি টাকা) অতিরিক্ত কেন্দ্র ভাড়া নিয়েছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
কমিটি সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়েছে। মিটার কেনাকাটা হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের জন্য সারা দেশে বিদ্যুৎ–সুবিধা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও বাড়তি খরচের অভিযোগ আছে। এসব প্রকল্পের অনিয়ম বা দুর্নীতির চিত্র স্পষ্ট করে প্রতিবেদনে আসেনি। জ্বালানি খাতে জ্বালানি তেল আমদানিতে দুর্নীতির বিষয়টিও তুলে ধরা যায়নি। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতেও লুটপাট হতে পারে বলে ধারণা করছে কমিটি। দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খননের নামে বাড়তি টাকায় প্রকল্প করা হয়েছে। এসবের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। ২০টি কূপের খননকাজ
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গাজপ্রমকে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি দুই কোটি ডলারের বেশি দামে। অথচ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এটি এক কোটি ডলারে করতে পারে।
যথাযথভাবে বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে, অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগও তুলেছে শ্বেতপত্র কমিটি। তাদের প্রতিবেদন বলছে, একই গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতার নামে দরপত্র ডেকে কাজ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে সাবকন্ট্রাক্ট (কাজ পাওয়া ঠিকাদার নিজে কাজ না করে ছোট ঠিকাদারকে দিয়ে করায়) হিসেবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত অধ্যায়ের প্রতিবেদনে নেতৃত্ব দিয়েছেন শ্বেতপত্র কমিটির সদস্য ও বুয়েটের অধ্যাপক ম তামিম। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের একটি আনুমানিক ধারণা দেওয়া হয়েছে। উৎপাদনের বাইরে বিদ্যুৎ খাতে আরও অনেক প্রকল্প আছে। জ্বালানিতেও আমদানির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। স্বল্প সময়ে সব অনিয়মের চিত্র তুলে আনা যায়নি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।