জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশের জাতীয় ফুল ‘শাপলা’। হাওড়, বিল ও দিঘিতেই বেশি ফোটে এই ফুল। তবে এই ফুল এখন আর আগের মতো সব জলাশয়ে দেখা যায় না। শাপলা ফুলের ফলকে বলা হয় ‘ঢ্যাপ’। মাঝে মধ্যে ফরিদপুরের নগরকান্দা, সালথা, মধুখালী, আলফাডাঙ্গা ও বোয়ালমারী উপজেলার পল্লির বাজারগুলোতে ঢ্যাপ বিক্রি করতে দেখা যেতো।
বিভিন্ন উৎসবে, বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গোৎসবে বিভিন্ন রকম খই, নাড়ু, মুড়ির মধ্যে অন্যতম ছিল ঢ্যাপের খই ও খইয়ের মোয়া। কিন্তু এসব আর দেখা যায় না বললেই চলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাপলা সাধারণত বদ্ধ অগভীর জলাশয়, হাওড়-বাঁওড়, ডোবা, খাল-বিল অঞ্চলে জন্মে থাকে। সাধারণত দুই ধরনের শাপলা ফুল দেখা যায়—সাদা ও লাল। শাপলা ফুল যখন জলাশয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো ফুটে থাকে তখন ওই জলাশয়ে এক অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। আর এ ফুল যখন ফলে রূপান্তরিত হয় তাকে স্থানীয় ভাষায় ‘ঢ্যাপ’ বলা হয়। এ ঢ্যাপের ভেতরে অনেক ছোট ছোট বীজ থাকে। আগেরকার দিনে এগুলো মানুষ উঠিয়ে নিয়ে ভেঙে রোদে শুকিয়ে খই ভাজতেন। এ খই খুবই সুস্বাদু হয়। একসময় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ শাপলা ফুলের ডাটা (স্থানীয় ভাষায় নাল) তরকারি হিসেবে খেতেন।
সালথা উপজেলার গুপিনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা হরিদাশ মজুমদার বলেন, ‘আগে দুর্গাপূজার দিনে হিন্দুদের এমন কোনো বাড়ি ছিল না যে বাড়িতে ঢ্যাপের খই, মোয়া পাওয়া যেতো না। আর এখন দশটি গ্রাম ঘুরলেও এই পূজার দিনে ঢ্যাপের খই বা মোয়া মিলবে কি না সন্দেহ।’
শুক্রবার সালথা উপজেলার গট্টি ইউনিয়নের আগুলদিয়া গ্রামের গৃহবধূ উন্নতি মন্ডলকে ঢ্যাপের খই ভাজতে দেখা যায়। দুর্গাপূজা উপলক্ষে তিনি ঢ্যাপের খই ভাজছিলেন। তিনি বলেন, ‘একসময় পূজার দিনে বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের মধ্যে ঢ্যাপের খই ও গুড় দিয়ে তৈরি ঢ্যাপের মোয়া ছিল খুব সুস্বাদু। এখন বর্ষা নেই, শাপলার ফল ঢ্যাপও পাওয়া যায় না।’
তিনি বলেন, পাশের বিল থেকে অল্প কিছু ঢ্যাপ কুড়িয়ে তার থেকে দানা শুকিয়ে রেখেছিলাম। সেগুলো দিয়ে পূজা উপলক্ষে খই ভাজা হচ্ছে। খই আর গুড় দিয়ে মোয়া তৈরি করা হবে।
বোয়ালমারী উপজেলার টোংরাইল গ্রামের শিক্ষিকা অঞ্জনা রানী বলেন, ‘ছোটবেলায় মা-কাকিদের সঙ্গে ঢ্যাপের খই ও মোয়া তৈরি করতাম। বিয়ের পরও তৈরি করেছি। দিন দিন শাপলা হারিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর হলো ঢ্যাপ চোখেই দেখি না।’
বামনগাতী গ্রামের গোপেন বিশ্বাস (৪৯) বলেন, ‘আমাদের বাড়ির পাশে বর্ষার দিনে ফসলি জমিতেও বর্ষার জলে ভরে যেতো। এখন বর্ষার সময় জল নেই। একেবার শুকনো, যা ৫০ বছরে এই প্রথম। এসব স্থানে প্রচুর শাপলা ফুল ফুটতো। ভোরবেলায় শাপলার সাদা ফুলের সৌন্দর্য খুব মুগ্ধতা ছড়াতো। শাপলার ফল ঢ্যাপ কুড়িয়ে তার দানা শুকিয়ে খই ভাজা এখন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়।’
কথা হয় বোয়ালমারীর কবি ও সাহিত্যিক কাজী হাসান ফিরোজের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দিন দিন আবহাওয়া, জলবায়ুসহ সবকিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে। ষড়ঋতুর সেই দেশ আর নেই। বর্ষার সঙ্গে সঙ্গে শাপলা হ্রাস পাচ্ছে। এখন আর ঢ্যাপ দেখা যায় না। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই ঢ্যাপ কী চেনা তো দূরে থাক, নামই জানে না।’
ফরিদপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, এখন আগের মতো বর্ষা হয় না। খাল-বিল বিলীন, জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক জলাভূমি ধ্বংসই এ সুস্বাদু শাপলা ও ঢ্যাপ বিলুপ্তির কারণ।
তিনি বলেন, শাপলার মাটির নিচের মূল অংশকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘শালুক’ বলে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিলের পানি যখন কমে যায় তখন গ্রামের অনেক মানুষ শালুক তুলে বাজারে বিক্রি করতেন। সিদ্ধ শালুক বেশ সুস্বাদু। খাল-বিল-জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে শাপলা জন্মানো ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।