জুমবাংলা ডেস্ত: ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে নির্মিত দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের বঙ্গবন্ধু তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারখানা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অর্ধ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের যন্ত্রাংশ। উপজেলার আবিরেরপাড়া মৌজায় অবস্থিত আদিবাসী উন্নয়ন সংস্থার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা হয় এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি।
ঘোড়াঘাট সরকারি ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এ জাতীয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান দেশে এটিই প্রথম। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষদের কিভাবে টেকসই উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করা যায়, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তাদের জন্য তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রস্তাবটি অনুমোদন ও বাস্তবায়নে বরাদ্দ প্রদান করা হলে “বঙ্গবন্ধু তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারখানা” স্থাপন করা হয়। প্রথম পর্যায়ে এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ২০টি তাঁত স্থাপন করা হয়। সেই সাথে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ১০টি তাঁতের কাঁচামাল ক্রয় করে প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন শুরু হয়।
জানা যায়, ঘোড়াঘাট উপজেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগে তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষদের কাপড় বুনন প্রশিক্ষণ দিয়ে সাবলম্বী করতে কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু পুঁজি ও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে বর্তমানে এই তাঁতশিল্পের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনও এ ব্যাপারে উদাসীন।
উপজেলা নির্বাহী কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৭ সালের মে মাসের ১৬ তারিখ ইউএনও হিসেবে ঘোড়াঘাট উপজেলায় যোগদান করেন টি এম এ মমিন। এরপর থেকেই তিনি উপজেলায় নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ১০টি উদ্যোগের মধ্যে গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষদের কুঠির শিল্প প্রশিক্ষণে স্বাবলম্বী করার কাজকে এগিয়ে নিতে তাঁত প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চালু করেন।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রকল্প বরাদ্দ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষদের উন্নয়নে বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত) শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ৫৯ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন বঙ্গবন্ধু তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারখানা। যেখানে নরসিংদীর মাধবদী থেকে পুরানো ২০টি তাঁত মেশিন আনা হয় এবং ১০টি তাতেঁর কাঁচামাল ক্রয় করে প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন শুরু করানো হয়।
প্রথমে ১৬টি মেশিন চালু করা গেলেও চারটি মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ এনে ওই চারটি মেশিন চালু করা হবে বলে বাকি মেশিনগুলো কাজে লাগানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি তাঁত মেশিন চালু হলে ঘোড়াঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় এখানকার তৈরী লুঙ্গি, গামছাসহ অন্যান্য কাপড়-চোপরের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। এরই অংশ হিসেবে উপজেলা সদরে ওসমানপুর কারখানার একটি শো-রুমও উদ্বোধন করা হয়। যাতে করে সব জায়গা থেকে মানুষজন ন্যায্য মূল্য এখানকার তৈরী শাড়ী লুঙ্গি ক্রয় করতে আসে (যেখানে কাঁচামাল ও শোরুম উদ্বোধনসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ মিলিয়ে দাঁড়ায় প্রায় আরও ১০ লাখ টাকা)। এই লক্ষ্যে সিরাজগঞ্জ থেকে দক্ষ প্রশিক্ষক আনা হয় এই কারখানায়। পাশাপাশি উন্নতমানের লুঙ্গিও প্রস্তুত করা হয়। অল্পদিনের মধ্যেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েরা চরকার মাধ্যমে মাক্কুতে সুতা তোলার কাজ শিখে কাজও শুরু করে। যেহেতু কারখানাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য স্থাপন করা হয়েছে, তাই কারখানা থেকে তৈরিকৃত পণ্যের ব্রান্ডিং নাম রাখা হয় “এথনিক”।
কারখানাটির পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অর্থায়ন পরিচালনা করেন ইউএনও। উৎপাদিত পণ্য কারখানা ও শোরুমে পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় করা শুরু হয়। বিক্রয় মূল্য রাখা হয় প্রতি পিস লুঙ্গি ২৫০ টাকা হতে ৮৫০ টাকার মধ্যে এবং গামছা প্রতি পিস ১১০ টাকার মধ্যে।
২০১৮ সালের ০৭ নভেম্বর বদলিজনীত কারণে বিদায় নেন ইউএনও টি এম এ মমিন। এরপরের ইউএনও ওয়াহিদা খানম একই দিনে ঘোড়াঘাটে যোগদানের পর ২০২০ সালের নভেম্বরের আগে পর্যন্ত প্রায় বছর দুয়েক কারখানাটি ভালোই চলছিল। কিন্তু ০২ নভেম্বর ইউএনও ওয়াহিদা এক নৃশংস হামলার শিকার হন (সারাদেশে আলোচিত) এবং তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। এরপর ওই মাসের ২৩ তারিখে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন রাফিউল আলম। কিন্তু করোনাকালীন সময় এবং একের পর এক ইউএনও বদলির কারণে কারখানাটির কার্যক্রম ধীরগতিতে রুপ নেয়। কিছুদিন পর পরই ৩/৪টি করে তাঁত মেশিন বন্ধ হতে থাকে এবং একে একে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েরাও কারখানায় আসা বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে একজন সহকারী প্রশিক্ষক ও
একজন কেয়ারটেকার ছাড়া বাকিরা বেতন-ভাতার সমস্যায় অন্যত্র চলে গেছেন।
অপরদিকে ২০টি তাঁত মেশিনের মধ্যে ১৮টি বিকল হয়ে পড়ে আছে। মাত্র দুটি তাঁত মেশিন কোনো রকমে খুড়িয়ে চললেও বর্তমানে পুঁজি ও যথাযথ তদারকির অভাবে বন্ধ প্রায় সম্ভাবনাময় এই কারখানাটি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কারখানায় অবশিষ্ট যে দুজন রয়েছে তাদের বেতন ভাতাও ৪/৫ মাস থেকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যদিও শর্ত ছিল কারখানা চলুক বা না চলুক প্রশিক্ষক, সহকারী প্রশিক্ষক এবং কেয়ারটেকাররা প্রতি মাসের নির্ধারিত সময়ে বেতন পাবেন। কিন্তু এখানে সে শর্তও ভঙ্গ হয়েছে।
অপরদিকে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েরা কারখানায় আসা বন্ধ করার কারণ জানতে গিয়ে পাওয়া যায় ভিন্ন রকম তথ্য।
বর্তমান ইউএনও রাফিউল আলম যোগদানের পর থেকে জনৈক এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। যিনি নিজেকে সকল ইউএনও’র আত্মীয় বলে পরিচয় দিতেন। তিনি বেশির ভাগ সময় ইউএনও রাফিউল আলমের সাথে কারখানায় আসা শুরু করে দেন এবং ইউএনও’র অনুপস্থিততে নিজেই কারখানার তদারকি শুরু করে দেন। তিনি বলেন- ইউএনও তার উপর দায়িত্ব দিয়েছেন। তার পর থেকেই শুরু হয় নানা রকম বিপত্তি। তিনি আস্তে আস্তে সকলের বেতন-ভাতা নিজেই দিতে শুরু করেন। বেশির ভাগ সময় কারখানা থেকে প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার দূরে তার বাড়িতে গিয়ে কর্মচারীদের বেতন নিয়ে আসতে বলতেন।
অন্যদিকে, শর্তানুযায়ী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ছেলে-মেয়েদের কাপড় উৎপাদনের লভ্যাংশের একটি অংশ দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি সেটিও বন্ধ করে দেন এবং মনমর্জি মতো কারখানা থেকে যাকে তাকে ছাঁটাই করেন। এমন অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় একটা সময় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সকল ছেলে-মেয়েরা কারখানায় আসা বন্ধ করে দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম, তপন কুমারসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, সরকারি ভাবে এত সুন্দর একটি কারখানা কেন যে বন্ধ হয়ে আছে তা আমরা জানি না। তবে এলাকায় এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার।
কারখানাটি পূর্বে ন্যায় আবারও চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট উদাত্ত আহ্বান জানান তারা।
কারখানার সহকারী প্রশিক্ষক বেলাল হোসেন বলেন, জনৈক ওই ব্যক্তি এখানকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই কারখানার এই অধঃপতন। যদিও নতুন ইউএনও যোগদানের পর থেকে এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। কিন্তু কারখানা চালানোর মতো অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। বর্তমানে আমি নিজেও ৪/৫ মাস বেতন পাই না। এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলাম কিন্তু এখন কিস্তি দেয়ার মতো সামর্থ নেই। পরিবারের বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে এত কষ্ট করে কিভাবে বেঁচে থাকবো। অনেক ঋণে জর্জরিত হয়ে গেছি। এভাবে চলতে থাকলে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ বাকি থাকবে না।
এ ব্যাপারে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি কারখানার বিষয়ে তেমন কিছু জানতাম না। যোগদানের পর থেকে উপজেলার সব বিষয়ে জানার চেষ্টা করছি। কারখানা থেকে আয়ের কোনো অবশিষ্ট ফান্ড আমি এসে পাইনি। এ মাসের মধ্যে আপাতত কারখানার দুটি তাঁত মেশিন চালু করবো। পর্যায়ক্রমে অন্য তাঁত মেশিনগুলোও চালু করার চেষ্টা করবো। ঘোড়াঘাট উপজেলা একটি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এখানে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্বিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।