সালমান পারভেজ সবুজ: পঁচিশ বছর ধরে সদা হাস্যোজ্জ্বল চুয়াল্লিশ বছরের রহিম আলী একটি প্রেট্রোল পাম্পে চাকুরী করছেন। পাম্প মালিকের খুব বিশ্বস্থ হওয়ায় অনেকটা ব্যক্তিগত সহকারীর ভুমিকায় ১৬/১৮ ঘন্টা ডিউট করতে হয়, মাসিক বেতন এখন ১২ হাজার টাকা। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে এবং কিছু টাকা ধার দেনা করে তার ছোট ভাইকে মালয়েশিয়াতে পাঠিয়েছেন। সম্প্রতি তার ভাই ব্যাংকে তার একটি একাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন।
অনেক উৎসাহ নিয়ে তিনি ব্যাংকে টাকা উঠাতে এসে শোানালেন অনেক আশার গল্প। তিনি স্বপ্ন দেখেন এবার তাদের ভাগ্য নিশ্চয়ই ফিরবে। যাইহোক কিছুক্ষণ বসার পরে ব্যাংক থেকে জানানো হলো টাকা পেতে এখনও দু-তিন দিন লাগতে পারে। তিনি একটু হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন।
দু’দিন পর তিনি আবার আসলেন ব্যাংকে। সেদিনও তিনি হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন। পরের দিন সকালে এসে আবারও মুখটা মলিন করে ফিরে গেলেন। বিকালে আবার আসলেন। তার হিসাবে আশি হাজার টাকা এসেছে শুনে তার মুখে যেন বিজয়ের হাসি। কিন্তু বোনাসের টাকা না পেয়ে তিনি মন খারাপ করলেন।
ক’দিন পরেই শাখারীগাতীর কাশেম সরদার এলেন ব্যাংকে টাকা উঠানোর জন্য। মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার ছেলে টাকা পাঠিয়েছেন। তাকেও ব্যাংক থেকে জানানো হলো টাকান আসেনি, এখনও দু-এক দিন লাগতে পারে। তিনি আবার দু’দিন পরে আসলেন। তার একাউন্টে এক লাখ টাকা এসেছে। বোনাসের আড়াই হাজার টাকা আসেনি। তাকে হতাশ দেখে ব্যাংকের একজন অফিসার বললেন, একটু বসেন। কথা বলে দেখি কি করা যায়। বলেই অফিসার শাখা ব্যবস্থাপকের কক্ষে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে জানালেন, যিনি আপনার টাকা পাঠিয়েছেন তার ডকুমন্টেস লাগবে। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে ডকুমেন্টস জমা দিলে বোনাসের টাকা পাবেন। কোন কথা না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল কাশেম আলী।
এর পরে কাশেম সরদার আর রহিম আলী কোনও দিন ব্যাংকে আসেননি। আর আসবেন কিনা জানা যায়নি। এভাবে সারাদেশের অসংখ্য কাশেম-রহিমরা ব্যাংকে হয়তো আসেন না। কিন্তু বিদেশ থেকে তাদের জন্য পাঠানো টাকা নিশ্চয়ই আসে। কোন মাধ্যমে আসে? উত্তরটা একেবারেই সহজ, হুন্ডির মাধ্যমে।
অর্থ পাচারের প্রধানতম সহজ মাধ্যম এই হুন্ডি। আর হুন্ডির মাধ্যমে তাদের এ অর্থ পাচারে সহায়তা করছে কিছু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং তাদের দোসরা। দেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচারের মূল কৌশল হচ্ছে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং। এছাড়াও অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্য, মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে, সোনা চোরাচালানে, বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়সহ বিভিন্ন এমএফএস (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস) এর মাধ্যমেও অর্থপাচার হচ্ছে। দেশের একটি অসাধু মহল, রাজনীতিবিদ, আমলা, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী থেকে জনপ্রতিনিধি এমনকি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরাও অর্থপাচার করছেন। এজন্যই দেশের বাইরে তাদের বেগম পাড়া, বিবি পাড়া, সাহেব পাড়া গড়ে উঠছে আর এ দেশের সিংহ ভাগ মানুষ তাদের গোলাম পাড়ায় বসবাস করে বেঁচে থাকার নিত্য লড়াই করছেন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি এক কর্মশালায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী অফিসিয়াল চ্যানেলে এসেছে ৫১ শতাংশ টাকা। হুন্ডিতে এসেছে ৪৯ শতাংশ।
তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে প্রবাসীদের প্রতি অনুরোধ করেন।
প্রাপ্ত তথ্য মতে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার টাকার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য অনুযায়ী একই বছরে হুন্ডির মাধ্যমে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের লেনদেন হয়েছে। সাধারণত ব্যাংকিং চ্যানেলের থেকে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন সহজতর এবং অধিকতর লাভবান হওয়ায় হুন্ডির প্রতি আগ্রহ বেশী। প্রবাসীরা অনেক সময় জরুরি প্রয়োজনে সম্পর্কের ভিত্তিতে হুন্ডিতে লোন করেও টাকা পাঠাতে পারেন। আবার রেটও বেশী পাচ্ছেন, কাগজপত্রের কোন ঝক্কি ঝামেলাও নেই। যা
ব্যাংকিং চ্যানেলে সম্ভব নয়। যা কাশেম-রহিমের দৃষ্টান্ত থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক স্বাক্ষাৎকারে ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেমিট্যান্স হুন্ডি হওয়া মানেই অর্থপাচার।
তাহলে একথা বললে উত্তুক্তি হবে না যে, এই ২০ বিলিয়ন ডলার যে পাচার হচ্ছে সেটা সরকারের শীর্ষ মহল অবহিত এবং প্রকারান্তে স্বীকৃত।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, করোনাকালীন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। কারণ বৈশ্বিক সে মহামারীর সংকটকালীন সময়ে আর্ন্তজাতিক বাজার প্রায় বন্ধ থাকায় হুন্ডিসহ অন্যান্য মাধ্যমে অর্থ পাচার করার সুযোগ কম ছিল। তাই করোনাকালীন সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যদিও আমদানী ব্যয়ও তেমন ছিলনা। করোনার সংকট কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরী করেছে তা কাটাতে বিশ্ব হিমসিম খাচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানী সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যপণ্য সংকট অত্যান্ত প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমদানী ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে ভুগছে বিশ্বের অনেক দেশ। বন পুড়লে তো দিবালয় এড়ায় না, বাংলাদেশও এ সংকট এড়াতে পারেনি।
ভবিষ্যাতের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়ার জন্য দেনদরবার করছে সরকার। ওই যে বড় বড় কোম্পানীর বিল বোর্ডের মতো আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের নিচে ছোট্ট করে লেখা থাকে ‘শর্ত প্রয়োজ্য’, যা সচরচার চোখে পড়ে না।
আইএমএফও গতমাসে ঢাকায় এসেছিলো এবং সরকারকে এ ভর্তুকি কমিয়ে আনার ছোট্ট একটি শর্ত দিয়ে গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার যে ভর্তুকি বাবদ যে অর্থ রাখা তার বেশীর ভাগই জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও কৃষি, রপ্তানী খাতের জন্য ব্যয় করা হয়। সরকার নজীরবিহীন ভাবে তেলের দাম বাড়ানোর পক্ষে আর্ন্তজাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি, তেলের পাচার রোধ করা, বিপিসির লোকসান কমানোর সাফাই গাইলেও বিশ্লেকগণ বলছেন মুলত আইএমএফ এই শর্তের অংশ হিসেবেই সরকার তেলের দাম বৃদ্ধি করেছেন। যা আপামর জনসধারণের চোখে পড়েনি। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, তেলের পাচার, ডলার সংকট ইত্যাদি জনসাধারণকে দেখানো হয়েছে ।
রুশ-ইউক্রেন সংকটে বিশ্বব্যাপি মুদ্রাস্ফীতির ঘোড়া লাগামহীন ভাবে ছুটে চলেছে। জীবন যাত্রার ব্যায় মেটাতে যখন জন-মানুষের জানে পানি উঠে যাচ্ছে, এমন সময়ে তেলের দাম বাড়ানোটা অভিশাপ হিসেবে কতটা দুঃসহ কষ্টের সৃষ্টি করেছে তা বলে বোঝানের মতো নয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার মাধ্যমে কিছুটা পরিস্কার হবে।
চৌগাছার হারান (ছদ্দনাম) একটি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনে চাকুরী করেন। বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা আছে। দুই মেয়ে নিয়ে কোনও রকম একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকে। যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। বাড়তি কিছু আয়ের জন্য তিনি রাতে রিকসা চালানো শুরু করেন। একদিন রাতে তার রিকসায় দুজন যাত্রী ওঠে এবং ফাঁকা জায়গায় গিয়ে তার চোখে গুল দিয়ে ছুরিকাঘাত করে রিকসা নিয়ে পালিয়ে যায়। হারান গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতলে ভর্তি হন এবং পরে তার চাকুরিটাও চলে যায় । সব হারিয়ে পথে বসলেন তিনি।
কোভিডের ধাক্কা সামলে শ্বি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, বিশেষ করে আমদানী ব্যয় মেটাতে ডলার সংকটে খাবি খাচ্ছে আমদানী নির্ভর দেশ গুলো। এরই প্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত ডলার সরবরাহ মেটাতে গিয়ে আইএমএফ এর ‘শর্ত প্রয়োজ্য’ এই শর্ত মেটাতে গিয়েই জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধি করতে হলো। যদি রেমিটেন্স প্রবাহ সহজতর করে, হুন্ডি’কে প্রতিরোধ করে, অর্থপাচার বন্ধ করতে পারতো তাহলে তো সরকারকে আর ডলার সংকটে পড়তে হতো না।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রসঙ্গে বেসরকারী টিভি চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ মোঃ মাজেদুল হক প্রিন্স বলেছেন, ‘রিজার্ভ বাড়তে আমাদেরকে আরো দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের মাধ্যমে ফরেন রেমিটেন্স বাড়াতে হবে, কেননা রাতারাতি রপ্তানীতে বৈচিত্র আনা সম্ভব নয়।’
তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করছি। তবে দেশে আজ যদি আইনের শাসন থকাতো, অপরাধীকে যদি আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যেত তাহলে এমন আপরাধ করার আগে সবাই নিশ্চয়ই দ্বিতীয় বার ভাবতো! অর্থপাচারের ড্রেনটা অন্ততঃ বন্ধ করা যেত। দুনীর্তি নিয়ন্ত্রণ করে, হুন্ডি ও অর্থপাচার করতে পারলে আর রিজার্ভ সংকটে পড়তে হতো না। দেশের ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট-২০১২’ সহ প্রচলিত বিদ্যমান আইনই সেটা করতে যথেষ্ট ছিলো। সুশাসন ও জবাবদীহিতার অভাবে পাচারকারীরা মনে করে দেশে কোন ভবিষ্যৎ নেই, আর এখানেই নিহিত সকল দূর্নীতির উৎস।
অর্থনীতিবিদ ড. এ বি র্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম মনে করেন, ‘অবৈধ আয়ের উৎসগুলো বন্ধ করতে না পারলে
এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে পাচার চলতেই থাকবে।’
আজ সুশাসন ও জবাবদীহিতা নিশ্চিত থাকলে রিজার্ভ সংকটে পড়তে হতো না, আইএমএফ এর শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধি করে, জনগণের নিকটে সরকারের প্রতিশ্রুত কর্তব্য পরিপালনে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। হয়তো হারানদের জীবন আজ চোখে মুখে মৃত্যুকে না দেখে সোনালী আগামীর স্বপ্ন দেখতে পারতেন।
সত্যিই সীমিত আয়ের মানুষের জন্য জীবন নির্বাহ করা আজ যে কতটা দূর্বিষহ হয়ে পড়েছে তা এক কথায় অবর্ণনীয়। দেশের কথা ভেবে, মানুষের কথা ভেবে, আসুন সকলে মিলে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘সর্বশক্তিমান তৈল’ এর ব্যবহার বন্ধ করি, সকলে এক যোগে কাজ করি, আইনের শাসন নিশ্চিত করি, সুশাসন ও জবাবদিহীতা প্রতিষ্ঠা করি এবং সকলে একত্রে একটু স্বস্তিতে জীবনযাপন করি।
লেখক: ব্যাংকার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।