উজাইর ইসলাম : বিগত কয়েক মৌসুমে রপ্তানিযোগ্য আমের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের আম রপ্তানির ভবিষ্যত উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে এবং এই প্রবণতা চলতি মৌসুমেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল হতে পারে, কিন্তু আমের প্রভাবটাই সবচেয়ে বেশি। ফলের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক, পুষ্টি, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব আমাদের সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত। বাংলাদেশি আমের অস্বাভাবিক স্বাদ, বৈচিত্র্য, দীর্ঘ শেল্ফ লাইফ, আকার এবং পুষ্টিগুণ আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন একটি ফল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় চার হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আমের চাষ হয়ে আসছে। বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া ও মিশরে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ করা হয়।
বাংলাদেশের মতো আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর জন্য আম রপ্তানি একটি লাভজনক ব্যবসায়িক সুযোগ হতে পারে। দেশের অনুকূল জলবায়ু, সমৃদ্ধ মাটি এবং বর্ধিত সূর্যালোক নিখুঁত আম চাষের পরিস্থিতি তৈরি করে। মার্জিত মিষ্টি ও স্বাদের গভীরতাসহ উচ্চতর ফল উত্পাদন করে ২০৩১ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা কয়েক মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে সক্ষম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই বাংলাদেশের জন্য উদ্যোগটি গ্রহণ করে আম রপ্তানি শুরু করার একটি দুর্দান্ত সুযোগ রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন ও কানাডায় আম রপ্তানি হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানি গত বছর পাঁচ বছরের গড় ছাড়িয়ে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন উইংয়ের (পিকিউডব্লিউ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই থেকে মে মাসের মধ্যে রপ্তানিকারকরা ৯৮০ টন আম বিমানযোগে পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ২ লাখ হেক্টর জমিতে ২৫ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন করে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের শীর্ষ আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি। গত বছর খিরশাপাট, গোপালভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালিসহ সাতটি জাতের প্রায় ১ হাজার ৭৩৮ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করে বাংলাদেশ গত বছর প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪০ ডলার আয় করেছে।। ২০২০-২১ অর্থবছরে আম রপ্তানি হয়েছে ৭৯০ মেট্রিক টন।
আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, যা ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের মতোই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) ধারণা করছে, চলতি বছর আমের প্রকৃত উৎপাদন হবে ২৮ লাখ মেট্রিক টন, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
আম রপ্তানিকারকদের দাবি, বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষের প্রসার ঘটছে, যার ফলে আম রপ্তানি বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পরও রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
ফল রপ্তানিকারকরা ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ অর্থবছরে দেশের জাতীয় ফল ৪ হাজার টন রপ্তানি করতে চান, যা গত অর্থবছরের দ্বিগুণেরও বেশি, যদিও ডিএই প্রায় ১০ হাজার টন রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
রপ্তানিকারকদের মতে, আম রপ্তানি মৌসুম মে থেকে জুলাই পর্যন্ত চলে। চলতি বছর মে মাসের শেষের দিকে আম রপ্তানি শুরু হবে। এ বছর আম রপ্তানি থেকে প্রায় ৬ লাখ ডলার বা ৬৪ কোটি টাকা আয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। রপ্তানিকারকদের দাবি, এয়ার মালবাহী খরচ বাদে প্রতি কেজি আমের রপ্তানি মূল্য ১৫০ থেকে ১৬০ টাকার মধ্যে। কৃষিপণ্য হিসেবে আম রপ্তানিতে সরকার ২০ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে থাকে।
বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভুটান, সুইজারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, ভারত, কুয়েত, নেদারল্যান্ডস, নেপাল, সুইডেন, সিঙ্গাপুর, সোয়াজিল্যান্ডসহ ১৫টিরও বেশি দেশ বাংলাদেশ থেকে আম আমদানি করে। পাঁচ বছর আগে মাত্র দুই-তিনটি দেশে আম পাঠানো হতো।
আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মেক্সিকো ও থাইল্যান্ডের চেয়ে কম আম রপ্তানি করে। গত বছর দেশে ২৫ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হলেও রপ্তানি হয়েছে মাত্র দুই হাজার মেট্রিক টন।
আম রপ্তানি বাড়ানোর জন্য এখনও উল্লেখযোগ্য সমস্যা রয়েছে যা সমাধান করা দরকার। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও গুণগত মানের জন্য আন্তর্জাতিক মান মেনে চলা, প্যাকেজিং ও পরিবহনের জন্য অবকাঠামো বৃদ্ধি এবং আম উৎপাদন ও রপ্তানিকে প্রভাবিত করে এমন কীটপতঙ্গ ও রোগ মোকাবেলা করা।
ফলের মাছি আম রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করে। এইসব কীটপতঙ্গ ফলের ক্ষতি করতে পারে এবং অন্যান্য ফসলে রোগ ছড়াতে পারে। বিশেষ সুরক্ষা গোষ্ঠী (এসপিএস) আইন মেনে চলার জন্য উত্পাদক, রপ্তানিকারক এবং সরকারী সংস্থাগুলোর জন্য ফলের মাছি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। এসপিএস সমস্যা সমাধানের জন্য, আমের কীটপতঙ্গ মুক্ত করার পদ্ধতি রপ্তানির জন্য খুবই প্রয়োজন।
আম রপ্তানিকারকরা কীটনাশক দূষণের সাথে লড়াই করছেন। এ সমস্যা সমাধানে আম চাষি ও রপ্তানিকারকদের অবশ্যই সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং কম রাসায়নিক ব্যবহার করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন উইং আম ই-ট্রেসেবিলিটি তৈরি করছে, যা আমের নিরাপত্তা ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে বাগান থেকে চূড়ান্ত গন্তব্যে আমের সম্পূর্ণ উৎপাদন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে। পাইলট প্রোগ্রামটি সফল হলে এই ই-ট্রেসেবিলিটি প্রযুক্তিটি প্রসারিত করা যেতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, ‘ভালো কৃষি পদ্ধতি (জিএপি) প্রত্যয়িত আম রপ্তানি বাগানের অভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সরকার প্রত্যয়িত আম বাগান স্থাপন করছে, যা এক-দুই বছরের মধ্যে আম রপ্তানি বাড়াবে।
শিপিংয়ের সময় ক্ষতি রোধ করতে আমগুলি অবশ্যই সঠিকভাবে প্যাকেজ এবং লেবেল করা উচিত, এটি এমন একটি দক্ষতা যা বেশিরভাগ রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। রপ্তানি ফলের প্যাকেজিং ও লেবেলিংয়ের রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতি দেখা দিলে আমদানিকারক দেশগুলো তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে।
বাংলাদেশের জাতীয় উদ্ভিদ সুরক্ষা সংস্থা (এনপিপিও) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন উইগে’র ফাইটোস্যানিটারি মানদণ্ডের ভিত্তিতে আম রপ্তানির জন্য অনুমোদিত হয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, পরিদর্শন, আন্তর্জাতিক ফাইটোস্যানিটারি প্রবিধানের সঙ্গে সম্মতি এবং রপ্তানির আগে সম্পূর্ণ প্রশংসাপত্রের গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য এই প্রতিষ্ঠানটির ক্ষমতা প্রসারিত করা দরকার।
বিশ্বব্যাপী আমের বাজারে প্রবেশ করতে চাইলে যে কোনো রপ্তানিকারককে অবশ্যই খোঁজ নিতে হবে। ক্রেতা এবং বাজার শনাক্ত করে, নিয়ন্ত্রক প্রয়োজনীয়তা, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ এবং সম্ভাব্য বিপদ এবং সমস্যাগুলি বোঝার মাধ্যমে, রপ্তানিকারকরা মুনাফা অপ্টিমাইজ করতে এবং এই লাভজনক এবং প্রতিযোগিতামূলক শিল্পে ঝুঁকি হ্রাস করতে পারেন। স্বাদ, গুণগতমান, আকার এবং প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাজারে আমের নির্দিষ্ট চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রপ্তানিকারকরা বাজার গবেষণা করে জানতে পারবেন কোন জাতের আমের চাহিদা রয়েছে এবং কোন দেশ ও অঞ্চলে আমের জোরালো চাহিদা রয়েছে।
আমের সেল্ফ লাইফ বাড়াতে বন্দর ও শিপিং সুবিধার আধুনিকায়ন এবং কোল্ড স্টোরেজ সুবিধাসহ আম রপ্তানির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য।
রপ্তানি পরিস্থিতিতে উপকারী পরিবর্তন এনে রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়ানো যেতে পারে, যেমন পরীক্ষার সুবিধা সম্প্রসারণ, প্যাকিং সুবিধা আপডেট করা এবং বাষ্প তাপ চিকিত্সার জন্য সুবিধা তৈরি করা। গুণগত মান, আন্তর্জাতিক মান মেনে চলা এবং সরকারি উদ্যোগ সমন্বিত করা গেলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক আমের বাজারের একটি বড় অংশ দাবি করার প্রশ্নে ভালো অবস্থানে রয়েছে।
লেখক : উজাইর ইসলাম, কলামিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।