জুমবাংলা ডেস্ক : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় যেন মামলার জোয়ার বইছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়কার ঘটনাবলি এবং বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত হত্যার ঘটনায় মামলা হচ্ছে। মামলার পাশাপাশি বেড়েছে মামলা বাণিজ্যও। এসব মামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে।
তবে ব্যক্তিগত শত্রুতা, এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্বের কারণে অনেক নিরীহ মানুষকে আসামি করার অভিযোগও উঠেছে। কোনোদিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বা ছাত্র-জনতার আন্দোলন ভিন্নদিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা ছিল না এমন ব্যক্তিও আসামি হয়েছেন। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ মামলা আতঙ্কে ভুগছেন। কখন কার বিরুদ্ধে মামলা হয়, গ্রেফতার হয় আতঙ্কে তটস্থ সাধারণ মানুষ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মামলা বাণিজ্যের এ অভিযোগ এখন ব্যাপক আলোচিত।
এসব মামলার ড্রাফট কপি ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য কোনো অনলাইন মাধ্যমে। এরপরই আসে মামলা থেকে নাম বাদ দিতে টাকার প্রস্তাব। রফাদফা হলেই আসামি থেকে মুক্তি। প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে বাণিজ্যের সুবিধার্থে প্রাথমিকভাবে বিত্তশালীদের নাম দিয়ে সাজানো হয় মামলার খসড়ার আসামি তালিকা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বেশ লেখালেখি হচ্ছে। তবে পুলিশ বলছে, মামলা বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজে আসছে না।
জেলার আখাউড়া উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের কৃষক দলের সভাপতি কাজী ইউসুফ। তিনি আখাউড়া উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ডের সদস্য। আখাউড়া থানায় সম্প্রতি করা বিস্ফোরক আইনের মামলার আসামি কাজী ইউসুফ। বিএনপি নেতা হয়েও বিএনপির করা মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। প্রতিহিংসার স্বীকার বলে জানিয়েছেন তিনি। কাজী ইউসুফ বলেন, আমার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মামলাজনিত কারণে তিনি অফিসে আসেন না। আমি বর্তমানে প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এ বিষয়টি কিছু লোকের সহ্য হচ্ছে না। তাই আমাকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।
একই ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের সদস্য আবদুস ছাত্তার মিয়া। তিনি ২১ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ভারতে তার ফুফার বাড়িতে সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছিলেন। তার পাসপোর্ট ও ভিসা তাই প্রমাণ করে। তিনিও বিস্ফোরক আইনের মামলার আসামি। আবদুস ছাত্তার মিয়া বলেন, ৫ আগস্টের ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। ওই সময়ে আমি দেশেই ছিলাম না, তাহলে ওই ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত কী করে? কাজী ইউসুফ ও আবদুস ছাত্তারের মত অনেকেই অপরাধ না করেও আখাউড়ায় বিস্ফোরক আইনের মামলার আসামি হয়েছেন।
পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে পাওয়া হিসেবে ৫ই আগস্টের পর জেলার বিভিন্ন থানায় রাজনৈতিক মামলা হয়েছে ২৯টি। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৯২৯ জনকে। প্রত্যেকটি মামলায় আরও এক থেকে দেড়শ অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে। এ ছাড়া আদালতেও হয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। থানায় হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে সদর মডেল থানায় ১৩টি। অন্য থানার মধ্যে আখাউড়ায় ৫টি, আশুগঞ্জে ৪টি, নবীনগরে ২টি এবং সরাইল, নাসিরনগর, বাঞ্ছারামপুর, কসবা ও বিজয়নগর থানায় ১টি করে মামলা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগই হত্যার অভিযোগে করা।
সরাইলের অরুয়াইল ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহ মিরান মামলা খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এখন। তার পুরো পরিবার বিএনপির সমর্থক। তার ভাই যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
শাহ মিরান বলেন, আমার অপরাধ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমি এ্যাকটিভ ছিলাম। আমাদের স্কুলের একটি জায়গা আওয়ামী লীগের লোকজন দখল করে রেখেছিল। ৫ই আগস্টের পর আমি এ নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম। দুজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও এই জায়গা দখলে জড়িত ছিল। তাদের বিষয়ে মন্ত্রণালয়, ডিসি ও ইউএনও অফিসে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। এ কারণে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। ইতোপূর্বে আমার পরিবারের কেউ মামলায় পড়েনি। আমি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি। মিরান আরও জানান, তার এলাকাতেই আরও অনেক নিরপরাধ লোক মামলার আসামি হয়েছেন।
বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল হককে মামলা ছাড়াই ১৫/২০ দিন আগে আটক করে পুলিশ। পরে তাকে মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপরই আতঙ্কে এলাকা ছাড়া হন ৪ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কামরুল, ৫নং ওয়ার্ডের রফিকুল ইসলাম, ৮নং ওয়ার্ডের সিরাজ মিয়াসহ ইউনিয়নের আরও কয়েকজন ইউপি সদস্য। কে কাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয় সেই আতঙ্কে আছেন এখন ওই এলাকার সবাই।
ওই ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য জানান, মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়ে বা আসামি থেকে নাম কাটানোর কথা বলে টাকা দাবি করা হচ্ছে। এসব কারা করছে তা সবাই জানে। কিন্তু ভয়ে মুখ খুলেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের দক্ষিণ মোড়াইলের ওষুধ ব্যবসায়ী মো. মোবারক হোসেনকে বাদী বানিয়ে তৈরি করা একটি মামলার এজাহারের খসড়া কপি গত মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ায়। এ বিষয়ে গত ৩১ অক্টোবর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন মোবারক। যাতে তাকে বাদী দেখিয়ে মামলার ভুয়া এজাহার তৈরি করে হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকে দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। মোবারক হোসেন জানান, মামলার কপি ভাইরাল হওয়ার পরই তার ছোট ভাই মোকারম হোসেন রবিন ফোন করে মামলার বিষয়টি সত্য কিনা তার কাছে জানতে চান। আমি কোনো কিছু জানি না বলে তাকে জানাই এবং নিরাপত্তার জন্যে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
গত ২৮ অক্টোবর সাড়ে তিনশ জনের বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এর আগে থেকেই অনলাইনে ভেসে বেড়াচ্ছিল এই মামলার কপি। নাম প্রকাশ না করে এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি ওই মামলার ৫ রকম আসামি তালিকা পেয়েছেন। দেখা গেছে একটিতে কারও নাম আছে, অন্যটিতে নেই। আসামিদের নামও আগে পিছে করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল যুক্তরাজ্য শাখার সদস্য সচিব ও জেলা শহরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহিম মিয়া বলেন, এই মামলাটি হওয়ার ৩ দিন আগে অনলাইনে ৩০০ জনের নামে মামলা হচ্ছে মর্মে একটি এজাহারের কপি পাই। আমার ছোট ভাই শাহ মোহাম্মদ ইয়াছিন মামলার কপিটা হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে পাঠায়। পরে দেখলাম থানায় রেকর্ডকৃত মামলায় আমার দুই ভাই ইয়াছিন ও কাওসারের নাম যথাক্রমে ২৯ ও ৩০ নম্বরে রয়েছে। অথচ আমার পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। ইব্রাহিম আরও বলেন, এই শহরে কে আওয়ামী লীগ আর কে বিএনপি-এটা সবাই জানে। যেসব মামলা হচ্ছে, আমার জানা মতে আসামিদের ২০ ভাগও ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।
আলোচনা আছে শহরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে দুটি মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার জন্য ২৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়। আরেক জনের কাছে ১৫ লাখ টাকা। মামলা থেকে বাঁচতে কেউ কেউ ২-৩ লাখ টাকা করে দিয়েছেন এমন তথ্যও চাউর আছে। নাম কাটার জন্যে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়েও অনেকের কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে জেলা শহর থেকে গ্রামের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ নিয়ে ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মোবারক হোসেন জানান, বিভিন্ন মামলায় তাদের ১২ কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। আমরা যেখানে ১৬ বছর নির্যাতনের শিকার হলাম। আমাদের আবার মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। ইতোমধ্যে আখাউড়ায় আমাদের গ্রাম কমিটির এক অর্থ সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী কোনো মামলা-মোকদ্দমা করেনি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি, প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের নামেই মামলা করা হোক। সাধারণ জনগণের নামে হয়রানিমূলক মামলা যেন না করা হয়।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সিরাজুল ইসলাম সিরাজ জানান, বিগত স্বৈরাচার সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়ে যারা নিহত হয়েছেন তাদের স্বজনরা তৎকালীন সময়ে কোনো মামলা করতে পারেননি। সরকার তাদের বিভিন্নভাবে বাধা দিয়ে রেখেছিল। সরকারের পতনের পর এখন তারা নিজ নিজ দায়িত্বে এসব মামলা করছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২১ সালে যেসব ঘটনা ঘটেছে এর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেনি। যেসব মামলা হয়েছে এতে তার দলের কেউ আসামি হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে জানান, দলের পদধারী কেউ আসামি হয়েছেন- এমন তথ্য তার জানা নেই। তবে মামলার শিকার হয়ে সাধারণ লোকজন হয়রানি বা ভোগান্তির শিকার হোক তা আমরা চাই না।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাবেদুর রহমান বলেন, দুয়েকটি মামলা আগে হলেও এখন তা হচ্ছে না। টাকা পয়সার জন্যে বা শত্রুতাবশত হয়রানিমূলক মামলার আসামি করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক যে মামলা হচ্ছে আমি বলেছি যে, ফৌজদারি অপরাধে জেনুইন ঘটনায় আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। যদি কেউ মনে করেন যে আপনার প্রতি হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে, চাপ সৃষ্টি করে টাকা পয়সা নেওয়ার জন্য অথবা শত্রুতামূলকভাবে এ মামলার আসামি করা হচ্ছে তাহলে আমাকে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেবেন। আমরা ইতিমধ্যে ৫-৬ জনের আবেদন পেয়েছি। তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার আমরা নিয়েছি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।