স্বামীনাথান নটরাজন ও খাদিজা আরিফ, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস : মোহাম্মদ শরীফ তার ছেলেকে কবর দেয়ার সুযোগ পাননি। তবে গত ২৭ বছর ধরে তিনি এমন হাজার হাজার পরিবারের সন্তানদের কবর দিয়ে আসছেন, যাদের মৃতদেহের কোনো দাবিদার নেই।
মোহাম্মদ শরীফের ছেলে যে মারা গেছে, পুলিশ তাকে এই তথ্যটি জানায় একমাস পরে। তবে শুধু এটুকুই, তার ছেলে কোথায় বা কীভাবে মারা গেছে তাও জানাতে পারেনি পুলিশ।
মোহাম্মদ শরীফ শুধু জানেন যে ১৯৯২ সালে একটি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে হওয়া হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ভারতজুড়ে যে ২ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল তার ছেলে মোহাম্মদ রইস।
২৫ বছর বয়সী রইসকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে, তাও জানে না তার বাবা।
“পুলিশ বলেছিল তার শরীর পচে গেছে”, প্রায় তিন দশক পর স্মৃতিচারণ করছিলেন মোহাম্মদ শরীফ। “আমরা তার মৃতদেহ দেখিনি, শুধু তার পোশাক পেয়েছি।”
তবে ঐ ঘটনার কয়েকদিন পর তিনি এমন একটি ঘটনা দেখেন যা তার জীবন আমূল পাল্টে দেয়।
“একদিন পুলিশ অফিসারদের দেখি নদীতে একটি লাশ ছুঁড়ে ফেলছে। দেখে আতঙ্কিত হই আমি”, আতঙ্কের সাথে সাথেই সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় অনুধাবন করেন তিনি।
“হয়তো আমার ছেলের দেহও ওভাবেই কোনো নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। সেদিন আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করি, আজ থেকে আমি বেওয়ারিশ লাশেদের অভিভাবক। আমি এদের সৎকারের ব্যবস্থা করবো।”
এসব বেওয়ারিশ লাশ নানা কারণে জমা হয় ভারতে: এসব দেহ সড়ক বা ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মানুষের যেমন হতে পারে, বাড়ি থেকে দূরের কোনো জায়গায় মারা যাওয়া মানুষের হতে পারে – আবার তীর্থযাত্রী, অভিবাসী, গৃহহীন বা সন্তানরা তাড়িয়ে দিয়েছে এমন বৃদ্ধদেরও হতে পারে।
আবার অনেক সময় অতি দরিদ্র ব্যক্তিরা হাসপাতালে মারা গেলে তাদের সৎকারের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসে না কেউ।
প্রশ্ন ওঠে, এই দেহগুলো নিয়ে কী করা হবে?
১৯৯২ সালে ভারতের অনেক জেলাতেই মর্গের সুবিধা ছিল না। কারো দাবি না করা বেওয়ারিশ লাশ দ্রুত কবর দেয়া এক ধরণের রীতিই ছিল।
এরকম লাশ কবর দেয়াই প্রথা ছিল। তবে উত্তর ভারতের কিছূ জায়গায় টাকা ও সময় বাঁচাতে বেওয়ারিশ লাশ নদীতেও ফেলে দেয়া হয়ে থাকে।
সবসময়ই মোহাম্মদ শরীফের পরিবারের সন্দেহ ছিল যে মোহাম্মদ রইসের দেহ গোমতী নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে – যখন উগ্রবাদী হিন্দুরা ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি করা অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে – মোহাম্মদ শরীফের বাড়ি থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের সুলতানপুরে কেমিস্ট হিসেবে কাজ করতেন মোহাম্মদ রইস।
অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে হওয়া সহিংসতার সময় নিখোঁজ হন রইস।
মোহাম্মদ শরীফ বলছিলেন, “আমার ছেলে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর এক মাস পাগলের মত তাকে সবখানে খুঁজেছি। কোথাও না পেয়ে সুলতানপুরে আসি।”
তারা যেই ভয়টা পাচ্ছিলেন, কিছুদিন পরই তা সত্যি প্রমাণিত হয়। তাদের ছেলে মারা গেছে।
ঐ ঘটনার পর মোহাম্মদ শরীফ ও তার স্ত্রী মানসিকভাবে চরম আঘাত পান। মোহম্মদ রইসের মা এখনো হঠাৎ হঠাৎ বিষণ্ণতায় ভোগেন।
ছেলের যথাযথ সৎকার করা সম্ভব না হওয়ার বিষয়টি তাদের কাছে অসহ্য বোধ হতে থাকে।
মোহাম্মদ শরীফ বলেন, “সেসময় আমি সিদ্ধান্ত নেই আমার জেলার একটা মরদেহও আমি সৎকার না করে নদীতে ফেলে দিতে দেবো না।”
ভারতের বর্ণ বৈষম্যপূর্ণ হিন্দু সমাজে যারা সবচেয়ে নিম্নবর্ণ, তাদেরকে সাধারণত মৃতদেহ পোড়ানো ও কবর দেয়ার মত কাজগুলো করতে বাধ্য করা হতো – ফলস্বরূপ তাদের ‘অচ্ছুত’ হিসেবেও বিবেচনা করা হতো।
কিন্তু ব্যক্তিজীবনে সাইকেল মেকানিক মোহাম্মদ শরীফ এসবের পরোয়া করেননি। তিনি পুলিশকে জানান যে সবার অপছন্দের এবং ঘৃণ্য এই কাজই তিনি করতে চান।
“কাজ করার প্রথম ফোনটি যখন আমি পাই, তখন আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। পোস্টমর্টেমের পর পুলিশ আমাকে দেহটি সৎকার করতে দেয়। আমার পরিস্কার মনে আছে, মৃতদেহের ঘাড় ছিল ভাঙ্গা।”
দ্রুতই তার কাজের পরিমাণ বেড়ে যায়। মরদেহ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চার চাকার একটি ঠেলাগাড়িও কেনেন তিনি।
সেসময় তার পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতরা একটা বড় ধাক্কা খায়। ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও মোহাম্মদ শরীফকে তার সাথে কাজ করা হিন্দু সহকর্মীদের মতই হেয় প্রতিপন্ন করা হতে থাকে।
“সেসময় আমার পরিবারের একজনও আমার ওপর সন্তুষ্ট ছিল না। তারা সবাই আমাকে বলে যে তুমি পাগল হয়ে গিয়েছ।”
“কেউ কেউ আমাকে ভয়ও পেত তখন। তারা মনে করতো আমার সংস্পর্শে এলে তারাও জীবাণূ দ্বারা সংক্রমিত হবে।”
কিন্তু এতকিছু স্বত্ত্বেও মোহাম্মদ শরীফ তার প্রতিজ্ঞা থেকে সরেননি। তিনি পরিবারের সদস্যদের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাননি, উৎসবের সময় আনন্দ উদযাপন করেননি, এমনকি কখনো কখনো প্রার্থনাও বাদ দিয়েছেন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে দেয়ার জন্য। এই কাজই তাকে শান্তি দিত, তার ছেলের মৃত্যুর দু:খ ভুলে থাকার শক্তি যোগাতো।
“আমার ছেলের মৃত্যুর শোক সামলাতে সাহায্য করতো ঐ কাজ। আমি প্রত্যেক মুহুর্তে তার কথা মনে করি।”
অনেকসময়ই পচা গলা, বিকৃত মরদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে মোহাম্মদ শরীফকে।
“যখনই বাজেভাবে বিকৃত হয়ে যাওয়া কোনো দেহ দেখেছি, তা আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। দু:স্বপ্ন দেখে রাত পার করেছি, ঘুমের ওষুধ খেয়েছি।”
মোহাম্মদ শরীফ সাধারণত একটি বিষয়েই জোর দিতেন। যথাযথভাবে সৎকার হচ্ছে কিনা।
তিনি যদি বুঝতেন যে লাশটি মুসলিম কোনো ব্যক্তির, তখন তার গায়ে একখণ্ড কাপড় জড়িয়ে প্রার্থনাবাক্য পাঠ করতেন। হিন্দু হলে সেটি দাহ করতে নিয়ে যেতেন তিনি।
মোহাম্মদ শরীফ ঠিক কতগুলো দেহ সৎকার করেছেন তার কোনো নিশ্চিত হিসাব নেই।
অযোধ্যা জেলা প্রশাসনের প্রধান অনুজ কুমার ঝা বিবিসিকে বলেন, “আমাদের একটা আনুমানিক ধারণা রয়েছে যে আমরা মোহাম্মদ শরীফকে আড়াই হাজারের মত দেহ সৎকার করতে দিয়েছি।”
তবে মোহাম্মদ শরীফ ও তার পরিবারের দাবি তিনি সাড়ে ৫ হাজারের বেশি মানুষের মরদেহ সৎকার করেছেন।
এই কাজের জন্য কখনো কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা পাননি তিনি। আজ পর্যন্ত তিনি নিয়মিত তার সাইকেলের দোকানে কাজ করেন, যেখান থেকে তার দৈনিক আয় হয় ৩ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
তবে সম্প্রতি তার অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তার অত্মোৎসর্গের প্রতিদান পেয়েছেন তিনি। ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারগুলোর একটির মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়েছে তাকে।
এখন স্থানীয় দোকানদাররা তার কাজের খরচ বহন করেন।
বর্তমানে ৮০ বছর বয়সে মোহাম্মদ শরীফ দু’জন সহকারী রেখেছেন যারা তাকে সৎকারের কাজে সাহায্য করে।
“হিন্দু, মুসলিম দুই ধর্মের লোকই আমাকে সাহায্য করে। মানুষ আমাকে খাবার ও কম্বল দান করে। সম্প্রতি আমার একটি চোখের অপারেশন হয়েছে। সেসময় একেবারেই অপরিচিত এক ব্যক্তি আমাকে ডেকে ২০ হাজার রুপি দেয়।”
মোহাম্মদ শরীফের দুই ছেলে বা তাদের সন্তানদের কেউই তার মৃত্যুর পর অচেনা মানুষের মৃতদেহের সৎকার করবে না। কিন্তু মোহাম্মদ শরীফ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই কাজ করবেন।
“আমি না থাকলে পুলিশ হয়তো আবারো নদীতে লাশ ছুঁড়ে ফেলা শুরু করবে।”
কিন্তু মোহাম্মদ শরীফ বেঁচে থাকতে এই দৃশ্য দেখতে পারবেন না। তাই তাকে মানুষ বলে ‘মৃতদের রক্ষাকর্তা।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।