ধর্ম ডেস্ক : তওবা ছিল নবী-রাসুলদের রীতি ও অভ্যাস, যা তাদের কাছে নিজেদের বিছানা বানিয়ে দিত বিস্বাদ। তাদের দাঁড় করাত নিজ প্রভুর সামনে। তারা তাঁর কাছে অবিরত প্রার্থনা করতে থাকেন ক্ষমা ও করুণার। দগ্ধ হৃদয়ে, বিগলিত চিত্তে ও অশ্রুময় চোখে।
দেখুন আদম (আ.)। জান্নাতে তার পদস্খলনের পর তিনি অনুশোচনার কড়া নাড়তে শুরু করেন। সংগোপন কাতর প্রার্থনা করতে থাকেন ‘তারা উভয়ে বলল হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন; তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব।’ (সূরা আরাফ : ২৩)।
নুহ (আ.) কে দেখুন। পিতৃস্নেহ তাকে ছেলের মুক্তির ব্যাপারে আশান্বিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। অথচ আল্লাহ তার ধ্বংস লিখে রেখেছেন। ফলে তার রব তাকে ভ্রর্ৎসনা করেন এভাবে ‘আল্লাহ বলেন, হে নুহ! নিশ্চয়ই সে আপনার পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চয়ই সে দুরাচার! সুতরাং আমার কাছে এমন দরখাস্ত করবেন না, যার খবর আপনি জানেন না। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, আপনি অজ্ঞদের দলভুক্ত হবেন না।’ (সূরা হুদ : ৪৬)। নুহ (আ.) তৎক্ষণাৎ আপন প্রভুর আদেশ মেনে নিয়ে তওবায় লুটিয়ে পড়েন ‘নুহ বলেন, হে আমার পালনকর্তা আমার যা জানা নেই, এমন কোনো দরখাস্ত করা থেকে আমি আপনার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব।’ (সূরা হুদ : ৪৭)।
আল্লাহর এ নবী যেহেতু প্রার্থনার মর্যাদা জানেন, তিনি জানেন তওবাই শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা; তাই নিজের মধ্যে বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখলেন না। বরং এতে সব মোমিন নর-নারীকে অন্তর্ভুক্ত করলেন। দোয়া করলেন নিজ প্রভুর কাছে ‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে, আমার বাবা-মাকে, যারা মোমিন হয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করে তাদের এবং মোমিন পুরুষ ও মোমিন নারীদের ক্ষমা করুন এবং জালেমদের শুধু ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন।’ (সূরা নুহ : ২৮)।
দেখুন দয়াময়ের বন্ধু ইবরাহিম (আ.) কে। একাই যিনি এক অনুগত উম্মত। বড় ধৈর্যশীল, কোমলপ্রাণ ও আল্লাহমুখী। তিনিও তওবা-ধ্বনি উচ্চারণ করছেন। ভয়ে-আশায় তিনিও নিজ দোয়ার একটা অংশ বানাচ্ছেন এ তওবাকে ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমাকে, আমার বাবা-মাকে এবং সব মোমিনকে ক্ষমা করুন, যেদিন হিসাব কায়েম হবে।’ (সূরা ইবরাহিম : ৪১)।
তিনি যখন তার জাতিকে নিজ মিল্লাতের দিকে আহ্বান করছেন এবং তাদের চেনাচ্ছেন তার রবের পরিচয়, এ দুশ্চিন্তাই তাকে পেয়ে বসে ‘ইবরাহিম বললেন, তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, যাদের পূজা করে আসছ। তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষরা? বিশ্বপালনকর্তা ব্যতীত তারা সবাই আমার শত্রু। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনিই আমাকে পথপ্রদর্শন করেন, যিনি আমাকে আহার এবং পানীয় দান করেন, যখন আমি রোগাক্রান্ত হই, তখন তিনিই আরোগ্য দান করেন এবং আমাকে নেয়ামত উদ্যানের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর। আর আমার পিতাকে ক্ষমা কর। সে তো পথভ্রষ্টদের অন্যতম এবং পুনরুত্থান দিবসে আমাকে লাঞ্ছিত করো না, যে দিবসে ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো উপকারে আসবে না; কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।’ (সূরা শুআরা : ৭৫- ৮৯)।
নিজ জাতির ব্যাপারে এ উদ্বেগই তাড়িয়ে বেড়ায় সম্মানিত নবী ঈসা (আ.) কে। ফলে তিনি আল্লাহর রহমতের ভিখারি হয়ে প্রার্থনা করেন ‘যদি আপনি তাদের শাস্তি দেন; তবে তারা আপনারই গোলাম এবং যদি আপনি তাদের ক্ষমা করেন; তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ।’ (সূরা মায়িদা : ১১৮)।
আরেক সম্মানীয় নবী মুসা (আ.) যখন নিজ সম্প্রদায় কর্তৃক গাভীকে প্রভু মেনে নেওয়া দেখে রাগান্বিত অবস্থায় ফিরে আসেন, তখন তাকেও ঘিরে ধরে এ উদ্বেগ। ত্বরিৎ তিনি নিজ রবের কাছে প্রার্থনায় বিগলিত হন ‘মুসা বললেন, হে আমার পরওয়ারদেগার, ক্ষমা কর আমাকে, আর আমার ভাইকে এবং আমাদের তোমার রহমতের অন্তর্ভুক্ত কর। তুমি যে সর্বাধিক করুণাময়।’ (সূরা আরাফ : ১৫১)।
তিনি যখন নিজ সম্প্রদায়ের লোকটিকে সাহায্য করতে চাইলেন, যে তার শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। তখন মুসা তাকে ঘুষি মারলেন এবং এতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ স্মরণ করলেন, তওবা অবলম্বন করলেন এবং ছুটে গেলেন নিজ রবের ‘তিনি বললেন, হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের ওপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সূরা কাসাস : ১৬)।
একইভাবে দেখুন আল্লাহর শক্তিশালী নবী দাউদ (আ.) কে। আল্লাহ তার সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলেন। তাকে দিয়েছিলেন প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাগ্মিতা। যখন লক্ষ করলেন যে, তিনি দুই পক্ষের মাঝে বিচার-মীমাংসায় সত্য থেকে সরে গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে নিজ রবের সামনে লুটিয়ে পড়লেন তওবা-প্রার্থনায় ‘দাউদের খেয়াল হলো যে, আমি তাকে পরীক্ষা করছি। অতঃপর সে তার পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল, সিজদায় লুটিয়ে পড়ল এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করল। আমি তার সে অপরাধ ক্ষমা করলাম। নিশ্চয়ই আমার কাছে তার জন্য রয়েছে উচ্চ মর্তবা ও সুন্দর আবাসস্থল।’ (সূরা সোয়াদ : ২৪-২৫)।
আর আগে-পরে সবার নেতা, বিশ্বজাহানের সাক্ষাৎ রহমত মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ (সা.) এর ইস্তেগফার ও ক্ষমাপ্রার্থনার কথা তো বলাইবাহুল্য। তিনি ছিলেন মানবজাতির মধ্যে নিজ রবের প্রতি সবচেয়ে বেশি অভিমুখী। তাঁর সামনে দাঁড়ানোর ভয়ে সবচেয়ে বেশি কম্পমান। তাঁর গজব, আজাব ও কঠিন শাস্তির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন তওবা-ইস্তেগফার। ফলে তওবা ছিল তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে। যেমন আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি। তিনি এরশাদ করেন ‘আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই আমি দিনে সত্তরবারের বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাঁর কাছে তওবা করি।’ (বর্ণনায় বোখারি)।
এটিই ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দিন-রাতের অবস্থা। যেমন আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বিছানায় না পেয়ে তার খোঁজে মসজিদে গিয়ে সেখানে তাঁকে সিজদারত দেখতে পেলাম। এ সময় তাঁর দুই পায়ের পাতা খাড়া ছিল। তিনি এ দোয়া পড়ছিলেন ‘আল্লাহুম্মা আউজু বিরিদাকা মিন সাখাতিকা ওয়া আউজু বিমুআফাতিকা মিন উকুবাতিকা ওয়া আউজুবিকা মিনকা লা উহসি সানায়ান আলাইকা আনতা কামা আসনাইতা আলা নাফসিকা।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে অসন্তুষ্টি থেকে, আর আপনার নিরাপত্তার মাধ্যমে আপনার শাস্তি থেকে আশ্রয় চাই। আর আমি আপনার কাছে আপনার (পাকড়াও) থেকে আশ্রয় চাই। আমি আপনার প্রশংসা গুনতে সক্ষম নই; আপনি সেরূপই, যেরূপ প্রশংসা আপনি নিজের জন্য করেছেন।’ (বর্ণনায় মুসলিম)।
উম্মুল মোমিনিন (রা.) নবীজি (সা.) এর ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য প্রয়াসের আরেকটি অদ্ভুত দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন এক রাতে আমি নবী (সা.) কে তালাশ করছিলাম। ভেবেছিলাম তিনি বোধ হয় অন্য কোনো বিবির কাছে গেছেন। আমি তাঁকে খোঁজাখুঁজি করে এসে আবার বিছানায় ফিরে এলাম। দেখলাম তিনি রুকু বা সিজদায় গিয়ে বলছেন সুবহানাকা ওয়া বিহামদিকা লা ইলাহা ইল্লা আনতা। আমি বললাম, আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোন। আমি এক জগতে আর আপনি আরেক জগতে। (বর্ণনায় মুসলিম)।
এভাবেই আল্লাহর প্রেরিত বান্দারা গোনাহ আর আল্লাহর ভয়ে সর্বদা কম্পিত থেকেছেন। এমনকি কেয়ামতের দিন আল্লাহ যখন পূর্বাপর সবাইকে একত্রিত করবেন, তখন সেই ভীতিকর জায়গায়ও তারা এই ভয়ে থাকবেন। সব মানুষও তখন অকল্পনীয় ও অসহনীয় উদ্বেগ-টেনশনে থাকবে। তখন কোনো কোনো মানুষ বলবে তোমরা কি দেখছ না, তোমরা কী অবস্থায় আছ এবং কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছ? তোমরা কি এমন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করবে না, যিনি তোমাদের জন্য তোমাদের রবের কাছে সুপারিশ করবেন? তখন কিছু লোক বলবে তোমাদের আদি পিতা আদম (আ.) আছেন। তখন সবাই তাঁর কাছে যাবে এবং বলবে হে আদম! আপনি পুরো মানবজাতির পিতা। আল্লাহ আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর রুহ থেকে আপনার মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন। তিনি ফেরেশতাদের নির্দেশ দেওয়ায় তারা সবাই আপনাকে সিজদা করেছে। তিনি আপনাকে জান্নাতে বসবাস করতে দিয়েছেন। আপনি কি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করবেন না? আপনি কি দেখছেন না, আমরা কী অবস্থায় আছি এবং কী কষ্টের সম্মুখীন হয়েছি?
তখন তিনি বলবেন আমার রব আজ এমন রাগান্বিত হয়েছেন এর পূর্বে এমন রাগান্বিত হননি; আর পরেও এমন রাগান্বিত হবেন না। তিনি আমাকে বৃক্ষটি থেকে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আমি তাঁর অবাধ্য হয়েছি। ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি। তোমরা অন্য কারও কাছে যাও। তোমরা নুহের কাছে যাও। তারা নুহের কাছে যাবে। অতঃপর ইবরাহিম, তারপর মুসা ও অতঃপর ঈসা (আ.) এর কাছে যাবে। সবাই আদম (আ.) এর মতো বলবেন। অবশেষে তারা মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে যাবে। তিনিই মানবতার জন্য সুপারিশ করবেন।… (বর্ণনায় বোখারি ও মুসলিম)।
এই যদি হয় আল্লাহর নির্বাচিত ও বাছাইকৃত বান্দাদের অবস্থা। তাহলে আমাদের অবস্থা কী? আমাদের করণীয় কী? আমাদের কত বেশি তওবা করা দরকার? দিনে কতবার আল্লাহর সামনে ইস্তেগফার করা উচিত?
শায়খ ড. আবদুল আজিজ বিন বান্দার বালিলা, ২৬ সফর ১৪৪১ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত
ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব, সূত্র : আলোকিত বাংলাদেশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।