গোলাম সাত্তার রনি ও হাবিব রহমান : ১৯৯৬ সালের ৯ মে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) লন্ডন ফেরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সুরত মিয়া কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাতে হত্যাকা-ের শিকার হন। ওই ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায় আসামি করা হয় কাস্টমসকে। আসামি পক্ষে অর্থাৎ কাস্টমসের পক্ষে ওই মামলায় সাক্ষী হন রাজধানীর উত্তরখানের বাসিন্দা মো. শফিকুল। এক্ষেত্রে শফিকুলের সঙ্গে কাস্টমসের একটি অদৃশ্য চুক্তি হয় যে, তাদের পক্ষে আদালতে সাক্ষী দেওয়ার বিনিময়ে শফিকুলের পাচারকৃত স্বর্ণের চালানে চোখ রাখবে না কাস্টমস।
অদৃশ্য, অলিখিত এ চুক্তি বাগিয়েই স্বর্ণ পাচারে ভীষণ বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি; গড়ে তোলেন সোনা চোরাকারবারে একচ্ছত্র আধিপত্য। এর পর অল্পদিনেই স্বর্ণ চোরাচালানে আন্তর্জাতিক চক্রের অন্যতম এক সদস্য হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেন; মো. শফিকুল ধীরে ধীরে হয়ে যান সোনা শফি। তার সোনার কারবারে এ পর্যায়ে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ন হন মনির হোসেন। দিন দিন চোরাকারবারের অন্ধকার জগতে আলো ছড়াতে থাকেন মনির, বাড়তে থাকে তার প্রভাব, খেতাবও
জোটে গোল্ডেন মনির হিসেবে। দোকানের সেলসম্যান গোল্ডেন মনির এবং হকারের পেশা থেকে আসা সোনা শফি মানিকজোড় গত কয়েক দশকে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন; অবৈধ পথে গড়ে তুলেছেন বিশাল বিত্ত-বৈভব। সম্প্রতি র্যাবের জালে ধরা পড়েছেন মনির। অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি, রাজউকের ভূমি দখলসহ নানা অপরাধের অভিযোগে গোল্ডেন মনিরের রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাসভবনে গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত অভিযান চালায় র্যাব, গ্রেপ্তার করা হয় গোল্ডেন মনিরকে। কিন্তু পালের গোদা সোনা শফি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
র্যাব বলছে, নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে কামানো গোল্ডেন মনিরের সম্পত্তির পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও অনেক বেশি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সিল নকল করে এবং প্রতিষ্ঠানটির কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে রাজধানীতে অন্তত ২শ প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন গোল্ডেন মনির।
সাড়ে ১২ ঘণ্টা অভিযানের পর গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, মনির হোসেনের বাসা থেকে বিদেশি একটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, চার লিটার বিদেশি মদ, ৩২টি নকল সিল, ২০ হাজার ৫০০ সৌদি রিয়াল, ৫০১ ইউএস ডলার, ৫০০ চাইনিজ ইয়েন, ৫২০ রুপি, ১ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার, ২ লাখ ৮০ হাজার জাপানি ইয়েন, ৯২ মালয়েশীয় রিঙ্গিত, হংকংয়ের ১০ ডলার, ১০ ইউএই দিরহাম, ৬৬০ থাই বাথ জব্দ করা হয়েছে। এগুলোর মূল্যমান ৮ লাখ ২৭ হাজার ৭৬৬ টাকা। এ ছাড়া ৬০০ ভরি স্বর্ণালংকার এবং নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে।
সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নেমে ঘটনার সত্যতা পায় র্যাব। ঢাকা ছাড়ার জন্য আজ রবিবারের একটি ফ্লাইটের টিকিটও কেনা ছিল মনিরের। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার আগেই র্যাবের জালে ধরা পড়েন এ স্বর্ণ চোরাকারবারি।
আশিক বিল্লাহ বলেন, নব্বইয়ের দশকে গাউছিয়া মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন মনির। এরপর রাজধানীর মৌচাকের একটি ক্রোকারিজ দোকানে তিনি কাজ নেন। সে সময় এক লাগেজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হলে মনির লাগেজ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ভারত, এই রুটে তিনি প্রথমে লাগেজে করে কাপড়, কসমেটিক, ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটারসামগ্রী, মোবাইল, ঘড়িসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আনা-নেওয়া করতেন। এই কাজগুলো করতে করতে তিনি লাগেজ স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। বায়তুল মোকাররমে একটি জুয়েলারি দোকান দেন, যা তার এই চোরাকারবারি কাজে সাহায্য করে।
সময়ের ব্যবধানে মনির বড় ধরনের স্বর্ণ চোরাচালানকারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার নাম হয়ে যায় গোল্ডেন মনির। চোরাচালানের দায়ে ২০০৭ সাল বিশেষ ক্ষমতা আইনে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। তিনি বলেন, রাজউকের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে ভুয়া সিল বানিয়ে সে বিপুল পরিমাণ ভূমি দখল করেছে; অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছে। ডিআইটি প্রজেক্ট ছাড়াও বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে তার ২০০ বেশি প্লট রয়েছে বলে র্যাব জানতে পেরেছে। রাজউকের সম্পত্তি বেদখল করে এবং স্বর্ণ চোরাচালানে করে বর্তমানে তার সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটির টাকার বেশি।
তিনি বলেন, রাজউকের ৭০টি ফ্ল্যাটের নথি নিয়ে গিয়ে আইনবহির্ভূতভাবে হেফাজতে রাখায় ২০১৯ সালে মনিরের বিরুদ্ধে রাজউক কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করে। সেটি চলমান রয়েছে। এ ছাড়া অনৈতিকভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিপুল সম্পদ অর্জন করায় তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা চলছে। লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভূমি জালিয়াতি সম্পর্কে মনির বলেছেন, ২০০১ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী, গণপূর্ত কর্মকর্তা ও রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক করে তিনি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভূমি জালিয়াতি শুরু করেন।
র্যাব জানায়, গোল্ডেন মনিরের অটোকার সিলেকশন নামে গাড়ির শোরুম রয়েছে। আমদানী নিষিদ্ধ পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যক্তিগত চলাচলে ব্যবহার করতেন গোল্ডেন মনির। যার প্রতিটির মূল্য তিন কোটি টাকা। এর মধ্যে ২টি গাড়ি বাসায় এবং ৩টি শোরুমে রাখতেন। পাশাপাশি গাউসিয়াতে একটি স্বর্ণের দোকান রয়েছে। ওই দোকানকে চোলাচালানের স্বর্ণ বিক্রির হপস্পট হিসেবে পরিণত করে মনির। গতকাল মেরুল বাড্ডার মনিরের ৬ তলা বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। বাড়িটির প্রথম তিন তলা ডুপ্লেক্স। এই বাড়িতেই পরিবার নিয়ে থাকেন মনির। পুরো বাড়িতে দামিসব আসবাবসহ অভিজাত্যের ছোয়া।
র্যাব আরো জানায়, র্যাব তার বিরুদ্ধে মূলত ফৌজদারি অপরাধ বিদেশি অনুমোদনবিহীন মুদ্রা রাখার জন্য বাড্ডা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করবে। তাছাড়া অস্ত্র এবং মাদক রাখার অপরাধে অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক অস্ত্র ও মাদকের মামলা করা হবে। গ্রেপ্তার মনিরকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব-৩ এর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুরো অভিযানে ছিলেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু।
র্যাব গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে আরো বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছে। এগুলো আনুষ্ঠানিক তদন্তের জন্য- দুদক, বিআরটিএ, মানি লন্ডারিং এর জন্য সিআইডি এবং ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার বিষয়ে এনবিআরকে তদন্তের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানাবে বলে জানিয়েছে র্যাব। এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে র্যাবের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে জানান, গত প্রায় ১৫ বছর ধরে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন গোল্ডেন মনির। এ তথ্যের সূত্র ধরে সে দলটির যেসব নেতা আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন, তাদেরও খোঁজ করা হচ্ছে।
টাকার কুমির মোহাম্মদ আলী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজগঞ্জের রিয়াজউদ্দিন, ঢাকা উত্তর সিটির ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সোনা সফি ও গোল্ডেন মনির এ চার সোনাকারবারি মিলে রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে নির্মাণ করেন বহুতল বাণিজ্যিক ভবন জমজম টাওয়ার।মোহাম্মাদ আলীকে শুল্ক গোয়েন্দারা বিপুল পরিমাণ টাকাসহ গ্রেপ্তার করে।
১৯৯৬ সালের ৯ মে লন্ডন থেকে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি সুরত মিয়া ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে নামেন। বন্দরে মদ্যপ সুরত মিয়া অসংলগ্ন আচরণ শুরু করেন। একপর্যায়ে তার পেটে কাচের বোতাল ঢুকিয়ে দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান। এস মিয়া হত্যাকা-ের ঘটনায় তার স্ত্রী সৈয়দা শামসিয়া বেগম বাদী হয়ে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় কাস্টমসের তিন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। পরে এই মামলায় কাস্টমসের পক্ষে আদালতে সাক্ষি দিয়ে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বেশ ছাড় পান স্বর্ণ চোরাকারবারি শফি। এসব নানা বিষয় নিয়ে সোনা শফির মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ওপ্রান্তে ফোন রিসিভ করেন তিনি। স্বর্ণের চোরাকারবারে সম্পৃক্ততার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে, সে প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে কিছুক্ষণ নিরব থেকে তিনি মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এর পর একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও অপরপ্রান্তের সাড়া পায়নি আমাদের সময়।
মনিরকে ‘স্বর্ণ ব্যবসায়ী’ হিসেবে আখ্যায়িত না করতে গণমাধ্যমের প্রতি বাজুসের অনুরোধ র্যাবের হাতে আটক ‘গোল্ডেন মনির’ স্বর্ণ ব্যবসায়ী নন- এমন দাবি তুলে ধরে গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। সংগঠনটির সভাপতি এনামুল হক খান ও সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালার স্বাক্ষরকৃত বিবৃতিতে বলা হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে জনৈক মনিরুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন মনিরকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। উক্ত মনির স্বর্ণ ব্যবসায়ী নন। তথাপি তাকে এ পরিচয়ে তুলে ধরায় দেশের সাধারণ স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, বাজুসের কোনো সদস্য এ ধরনের কোনো কর্মকা- সমর্থন করেন না। বরং এ ধরনের অবৈধ কার্যকলাপ নিধনে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায়। ভবিষ্যতে প্রয়োজনসাপেক্ষে তবে এ ধরনের সকল প্রকার অবৈধ কাজ শক্ত হাতে নিধন করতে সরকারের পাশে থাকবে সংগঠনটি।
সূত্র : দৈনিক আমাদের সময় অনলাইন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।