জুমবাংলা ডেস্ক : শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলায় মাছের খামার থেকে লোনা পানির একটি কুমির উদ্ধার করেছে জেলেরা। আগের রাতে উপজেলার আল-ওয়ালপুর ইউনিয়নের গাইমারা এলাকার একটি খামারে ফাঁদ পেতে জেলেরা কুমরিটি ধরেন। জানা যায়, এর পরের দিন দুপুর ১২টায় গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাফী বিন কবির কুমিরটিকে বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী অপরাধ ইউনিটের কর্মকর্তা ছানাউল্লাহ পাটোয়ারীর কাছে হস্তান্তর করেন। সানাউল্লাহ পাটোয়ারীর বক্তব্য বলে উল্লেখ করা হয়- ‘জলবায়ু পরিবর্তনে মিঠা পানির স্তর কমে যাওয়ায় জোয়ারের লবণাক্ত পানির কারণে ২০০ কিলোমিটার অতিক্রম করে এখানে চলে এসেছে। জনাব সানাউল্লাহর উক্তিটি সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এ বিষয়ে যথাযথ অনুসন্ধান প্রয়োজন।
দেশে লোনা পানির কুমিরের প্রজাতি Crododilusporosus সুন্দরবন ও তার আশপাশে এলাকার লোনাপানিতে রয়েছে, অন্য কোথাও নয়। অতএব ওই লোনাপানির কুমিরটি ২০০ কিলোমিটার উজানে শরীয়তপুরে কিভাবে এলো? সুন্দরবন থেকে শরীয়তপুর পর্যন্ত পানি কি এতটাই লবণাক্ত হয়ে গেল যে, লোনাপানির বিস্তারের কারণে ওই প্রজাতির কুমিরের শরীয়তপুর পর্যন্ত আসা। অস্বাভাবিক নয় কি? একটু খটকা লাগছে না? শুধু ওই কুমিরটি একাই শরীয়তপুরে চলে এলো, অন্যরা নয় কেন?
বাংলাদেশে অনেক আগে থেকে মিঠাপানির কুমির বিলুপ্ত, লোনাপানির কুমির সুন্দরবন ও সুন্দরবনে পারিপাশ্বিক এলাকাজুড়ে আছে। অন্য দিকে, ঘড়িয়ালের অস্তিত্ব বড় বড় নদীতে অত্যন্ত নগণ্যসংখ্যক ছিল বলে ধারণা করা হতো। আমার শিক্ষকতা ও গবেষণা জীবনের এক লম্বা সময় ধরে তথা ২০০০ সাল থেকে ১২-১৩ বছরের গবেষণার সময় ঘড়িয়ালের আবাস, বিস্তার ও পরিণতির ওপর অতীতের কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তবে গবেষণার ফলে প্রতীয়মান হয়, দু’-একটি ঘড়িয়াল ছানা জেলেদের জালে ধরা পড়ে বর্ষা মৌসুমে যখন ফারাক্কা বাঁধের সবকটি ¯স্লুইচ গেট খুলে দেয়া হয়। সুতরাং মিঠা পানির কুমির কিংবা ঘড়িয়াল কোনোটাই নেই। এ দেশ থেকে বিলীন, বিলুপ্ত। রয়েছে শুধুই লোনাপানির কুমির। আমাদের নদীগুলোর মরণের জন্য দায়ী প্রধানত ফারাক্কা। সারা বছর পানি থাকে না, বর্ষা মৌসুমে স্র্রোতে প্রচণ্ড পলিঘটায় নদীর নাব্যতাহীনতা। এ ছাড়া খেকোদের নদী খেয়ে ফেলা তথা নদী দখলও কি কম দায়ী! খেকোরা কিনা খেয়ে ফেলল। নদী, খাল, বালি, মাঠ, ঘাট, পার্ক, পুকুর, বন্যপ্রাণী, কী না। এখন তো রাস্তার মাটিও খেয়ে ফেলছে।
বন্যপ্রাণীর রমরমা ব্যবসায়, পাচার চলছে, দেখার কি কেউ আছে? মাছের খামারে কুমির? খামারের মালিকের বক্তব্য কী? চোরাকারবারির সাথে মাছের খামারের কেউ জড়িত নয় তো? নির্দোষ কাউকে দোষী করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে যথাযথ কারণ না খুঁজে আমরা একটা কিছু বলে দিচ্ছি না তো? সুতরাং আমাকে বলতে হবে- বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে মাথায় নিয়ে যথাযথ কারণ খুঁজে বের করা হোক এবং সে অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হোক।
বর্ষা মৌসুমে যখন দেশের কোনো কোনো অঞ্চল পানির তলে ডুবে যাওয়ার অবস্থা দেখা দেয় তখন ফারাক্কার সবগুলো ¯স্লুইস গেট খুলে দেয়া হয়; তাদের দেশরক্ষা তথা দেশের মানুষ ও সম্পদ রক্ষায়। এদিকে আমাদের ফসলি জমিসহ সমস্ত সম্পদ তলিয়ে যায় পানিতে। হাজার হাজার বাড়ি, গাছপালা, ফসলের ক্ষেত প্রভৃতি পানিতে হারিয়ে যায় চিরতরে। অন্য দিকে, ভারত সরকার ঘড়িয়ালের সংখ্যার প্রবৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম ঘোষণা ও তত্ত্বাবধান গুরুত্বের সাথে নিয়েছে সেই ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে। ফলে ঘড়িয়ালের সংখ্যা প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে ওই দেশটি। ওইসব অভয়াশ্রমের ঘড়িয়াল বাচ্চা যখন এক মিটার আকার ধারণ করে তখন প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়া হয়। এ বাচ্চাদের কেউ পানির তোড়ে খেই হারিয়ে আমাদের নদীগুলোতে এসে পড়ে। বস্তুত আমাদের প্রকৃতিতে কোনো ঘড়িয়ালের অস্তিত্ব নেই। নেই প্রজনন ক্ষেত্র।
ফারাক্কাই এর জন্য মূলত দায়ী। কেননা, প্রজনন মৌসুমে নদীগুলো এতটাই শুকিয়ে থাকে যে, মা ঘড়িয়ালের পক্ষে সম্ভব হয়নি কূলে চলে আসে বাসা তৈরি ও ডিম পাড়ার প্রয়োজনে। এভাবে ঘড়িয়ালের অস্তিত্ব বিলীন। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে পানির তোড়ে যে দু’-একটি বাচ্চা ঘড়িয়াল আমাদের বড় নদীগুলোতে ধরা পড়ে জেলের জালে তাও জেলেরা পিটিয়ে মেরে ফেলে জালরক্ষায়, জাল কেটে দিয়ে বাচ্চাটি রক্ষা করার দৃশ্য কখনো দেখা যায়নি। বস্তুতপক্ষে আমাদের দেশে প্রকৃতিতে ঘড়িয়ালের যথাযথ আবাস আর ফিরে আসবে না। ফারাক্কা শুধু আমাদের বছরের একটি সময় অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে ডুবিয়ে মারে আর একটি সময় শুকিয়ে মারে তা নয়, প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন করেছে বহু প্রজাতির প্রাণী। এ সবই আমাদের দৃষ্টির আড়ালে, এই আর কি!
লেখক : ড. নূর জাহান সরকার, বন্যপ্রাণী ও পরিবেশবিশেষজ্ঞ,
প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।