ইতালি নিয়ে ভালো কাজ দেবে বলে প্রলোভন দেখায় দালাল। এ জন্য দিতে হবে ১৫ লাখ টাকা। এতে প্রলুব্ধ হন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বাসিন্দা রিপন শিকদার। টাকাটা দিয়ে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি ইতালির উদ্দেশে রওনা হন তিনি।
কিন্তু দুবাই হয়ে তিনি পৌঁছান লিবিয়ায়। কাজের বদলে জোটে নির্যাতন। উল্টো আরো সাড়ে ২৫ লাখ টাকা খরচ করে গত ২১ জুন দেশে ফিরে আসতে হয়েছে তাঁকে। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
এসব তথ্য জানিয়ে রিপন শিকদার বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল ইতালি পাঠানো হবে।
এ জন্য নেওয়া হয় ১৫ লাখ টাকা। পরে আমাকে দুবাই পাঠানো হয়। দুবাই পাঁচ-ছয় দিন রেখে আমাকে মিসর নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাকে লিবিয়া নিয়ে যায়।’
রিপন শিকদার বলেন, ‘লিবিয়া নিয়ে দালালচক্র আমাকে প্রচুর নির্যাতন করতে থাকে, আর বলে টাকা দিতে। এভাবে আরো সাড়ে ২৫ লাখ টাকা দিয়েছি। আমি লিবিয়া থাকতেই আমার পরিবার মামলা করে। কিন্তু এখনো সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। আসামিও গ্রেপ্তার হয়নি।’
শুধু রিপন শিকদারের মামলা নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবপাচার মামলাসংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এমন চার হাজার ৩৬০টি মামলা ঝুলে আছে। এর মধ্যে এক হাজার ৩৪৬টি মামলা এখনো তদন্তাধীন। তিন হাজার ১৪টি মামলা বিচারাধীন।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ৩০ জুলাই পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবপাচার প্রতিরোধ দিবস। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে এই দিনটিকে মানবপাচার দিবস ঘোষণা করে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘সংঘবদ্ধ অপরাধ মানবপাচার, বন্ধ হোক শোষণের অনাচার’।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যে দেশগুলোর মানুষ ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করছে, বাংলাদেশ এখন সেই তালিকায় প্রথম। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ৯ হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি অবৈধ পথে ইতালি প্রবেশ করেছে।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য বলছে, এভাবে যাঁরা ইউরোপে যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছর। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বাংলাদেশের ১০-১২টি জেলার লোকজন এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসব ক্ষেত্রে এখন সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকের নানা গ্রুপ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার শীর্ষে বাংলাদেশিরা। এভাবে ইতালি যাওয়ার পথে অনেক প্রাণহানি ঘটে। এ ছাড়া লিবিয়ায় অনেক মানুষ ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হন। ক্যাম্পে বন্দি রেখে তাঁদের নির্যাতন করা হয়। এরপর পরিবারকে টাকা দিতে বাধ্য করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘এই যে বিদেশে কাজ বা শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার, এটি ভয়াবহ সমস্যা। পাচারকারীরা এখন তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সে তুলনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পিছিয়ে। আবার পাচারের মামলাগুলোরও বিচার হচ্ছে না।’
মানবপাচারে বাড়ছে নতুন রুট ও কৌশল : ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, মানবপাচারকারীরা এখন শুধু সাগরপথে নয়, ভিজিট ভিসা, কনফারেন্স ইনভাইটেশন, ওয়ার্ক পারমিট ও হজ ভিসাও ব্যবহার করছে। দুবাই-লিবিয়া হয়ে ইউরোপ আবার দুবাই-সার্বিয়া-স্লোভেনিয়া হয়ে ইতালি কিংবা সৌদি আরব হয়ে রাশিয়া।
ব্র্যাক বলছে, দুবাইয়ে বিউটি পার্লার বা রেস্টুরেন্টে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে সেখানে নিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডান্স ক্লাব ও যৌন ব্যবসায় বাংলাদেশিদের বাধ্য করা হচ্ছে। শুধু দুবাই নয়, বর্তমানে নারীদের ভিজিট ভিসায় মালয়েশিয়ায় বিউটি পার্লারে কাজ করানোর নামে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁদের ডান্স ক্লাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর যৌনকাজে বাধ্য করা হয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশিরা সাইবার স্ক্যামে ভয়াবহ নির্মমতার শিকার হচ্ছে। মায়ানমারের ভয়ংকর স্ক্যাম সেন্টার থেকে চলতি বছরই উদ্ধার হয়ে আসেন ১৮ জন বাংলাদেশি। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা দুবাইয়ে কাজ করতেন। সেখানে ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে ফেলে থাইল্যান্ড হয়ে মায়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অস্ত্রের মুখে দিনের পর দিন কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
ইউরোপে পাঠানোর কথা বলেও এখন বাংলাদেশিদের নেপালে নিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে। যেহেতু নেপাল প্রবেশে অন অ্যারাইভাল ভিসা আছে, সে ক্ষেত্রে সহজে পাচারকারীরা কর্মীদের নেপালে নিয়ে যাছে। এ ছাড়া মানবপাচারকারীরা বর্তমানে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, তিউনিশিয়া, রাশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, সার্বিয়ার মতো দেশ ব্যবহার করছে।
লিবিয়ার যাত্রাপথ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দুবাই-মিসর হয়ে লিবিয়া গেছেন সবচেয়ে বেশি মানুষ। এ ছাড়া ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল-দুবাই হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে কাতার হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে দুবাই-সিরিয়া হয়ে লিবিয়া এবং অল্প কিছু লোক ঢাকা থেকে সরাসরি লিবিয়া গেছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।