জুমবাংলা ডেস্ক : অলি উল্লাহর বয়স মাত্র ২৫ বছর। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবার থানার সায়েদাবাদ গ্রামে। খুব ছোট বেলাতেই মা হারিয়েছেন তিনি। বাবাও মারা গেছেন বছর খানেক আগে। সৎ মায়ের ঘরে ঠাঁই হয়নি তার, তাই বড় হয়েছেন নানা বাড়িতে। কিন্ত এই পৃথিবী ছেড়ে এখন বাবা-মায়ের কাছেই চলে যেতে চান অলি উল্লাহ। কারণ তিন বছরে ধরে বিছানাবন্দী হয়ে আছেন তিনি।
অলি উল্লাহর দুই পা প্যারালাইজড। স্পাইনাল কটে আঘাতের কারণে মেরুদণ্ড অকোজো হয়ে গেছে। বিছানায় বন্দী থাকতে থাকতে শরীরের একাধিক স্থানে ঘা হয়ে গেছে। কিন্তু ২০১৭ সালেও একজন সুস্থ সবল যুবক ছিলেন অলি উল্লাহ। সেই বছরের জুনের দিকে একটি ‘দুর্ঘটনা’ তাকে এখন মৃত্যু পথযাত্রী করে তুলেছে।
অলি উল্লাহর অভিযোগ, তার এই পঙ্গুত্বের জন্য দায়ী স্থানীয় মো. স্বপন নামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। বছর তিনেক আগে জোর করে অলি উল্লাহকে শিমুল গাছে উঠিয়ে দিয়েছিলেন স্বপন। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গাছে তুলে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই গাছ থেকে মাটিতে পড়ে যান অলি উল্লাহ। এতে স্পাইনাল কটে তীব্র আঘাত পান তিনি। পরে দ্রুত তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখাকার চিকিৎসকেরা জানান, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করতে পারলে অলি উল্লাহ সুস্থ হয়ে উঠবেন। আর না করতে পারলে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে।
সে কারণে তাকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। সামাজিকভাবে চাপের মুখে পড়ে বাধ্য হয়েই অলি উল্লাহকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন সেই প্রভাবশালী স্বপন। কিন্তু ঢাকায় এনে অলি উল্লাহকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েই স্বপন পালিয়ে যান বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর পরিবারের। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশন তো দূরের কথা চিকিৎসাও ঠিকমতো হচ্ছিল না অলি উল্লাহর। ওই হাসপাতালে কেউই ছিলেন না এতিম অলি উল্লার।
অবশেষে নানা ও খালার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিন সপ্তাহ পরে নিজের অপারেশন ব্যবস্থা করেন অলি উল্লাহ। কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। অপারেশন হলেও স্পাইনাল কটের শক্তি হারিয়েছেন তিনি। ধীরে ধীরে প্যারালাইজড হয়ে গেছে তার দুই পা। সেই থেকেই বিছানা এবং ঘরবন্দী হয়ে গেছে অলি উল্লাহর জীবন।
মা বেঁচে না থাকায় নানা বাড়িতে আশ্রয়ে থাকা অলি উল্লাহর সাম্প্রতিক সময়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসা করার মতো টাকা নেই এতিম অলি উল্লাহর। খোঁজ নেন না সেই প্রভাবশালী স্বপনও। এ কারণে নীরবে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন অলি উল্লাহ। তার এই অবস্থার জন্য দায়ী যে স্বপন, তাকে স্থানীয়রা বহুবার অনুরোধ করছেন অলি উল্লাহ চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার। কিন্তু এলাকাবাসীর এমনকি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরাও চেষ্টা করে সেই স্বপনের কোনো সাড়া পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
যা ঘটেছে অলি উল্লাহর জীবনে
বর্তমানে কুমিল্লা পিপলস্ হসপিটালে চিকিৎসাধীন অলি উল্লাহ বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি বাড়িতে পুকুরে গোসল করতেছিলাম। তখন স্বপন ভাই পুস্কনীর (পুকুরের) পুর্ব পাশ থেকে আমাকে ডাকাডাকি করছিলেন। তখন আমি গেছি। তিনি আমাকে বলেন, তার তুলা গাছ (শিমুল গাছ) থেকে তুলা পেড়ে দিতে। আমি বলছি, ভাই আমি তুলা গাছে উঠতে পারব না। শরীরটা ভালো না। দুই-তিনবার না করার ফলে তিনি অনেক ক্ষিপ্ত হয়ে যান। আসলে তারা এলাকার অনেক প্রভাবশালী তো। ক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার পর আমি ভয়ে গাছে উঠি। গাছের ওঠার পরই আমি গাছ থেকে মাটিতে পড়ে যাই। তখন আমার মেরুদণ্ডে প্রচন্ড আঘাত লাগে।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে বলে দেয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমার অপারেশন করতে হবে। না হলে আমি চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবো। তারা আমাকে ঢাকার ট্রমা হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলে। আমার মা নেই। বহু আগে মারা গেছেন। নানাই আমার সব। তখন নানা স্বপনকে বলেন, যেভাবেই হোক চিকিৎসার ব্যবস্থা করার। দরকার হলে জমি বেইচা টাকা দেবো। তাও আমার চিকিৎসা করতে বলেন নানা।’
অলি উল্লাহ আরও বলেন, ‘পরে সেই রাতেই আমাকে ঢাকায় আনা হয়। হাসপাতালে এসে সাইনবোর্ডে লেখা দেখি, পঙ্গু হাসপাতালে আমাকে আনা হয়েছে। কিন্তু নেওয়ার কথা ছিল ট্রমা হাসপাতালে। পঙ্গু হাসপাতালেও চিকিৎসা ভালো হয়-এটা আমি জানি। কিন্তু একটু বেশি দেরি হয়। আমার যেহেতু নার্ভের সমস্যা, তাই দ্রুত অপারেশনের জন্য আমি ট্রমাতে যেতে চাইছিলাম। আমার পরিবারের সদস্যরা বলেছিল তারাই চিকিৎসা করাবে। কিন্তু তিনি (স্বপন) কারও কথা শোনে না।’
অলি উল্লাহ বলেন, ‘পরে নানাভাবে বুঝিয়ে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে তিনি চলে যান। চার দিন পরেও হাসপাতালে আমার অপারেশন হচ্ছিল না। তিনি শুধু বলেন আজ না কাল হবে-এভাবেই ঘোরাচ্ছিল৷ আসলে তিনি কোনো ডাক্তারদের সঙ্গে কথাই বলেন নাই। পরে আমি আমার খালার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে তাদের মাধ্যমে হাসপাতালে কথা বলে ১৯ দিন পরে অপারেশনের ব্যবস্থা করেছি। স্বপন বলেছিলেন, অপারেশনের সব টাকা তিনি দিবেন, কিন্তু একটি টাকাও দেয়নি। পরে ঢাকার পরিচিত এক বিত্তবান লোক আমার অপারেশনের টাকা দিয়ে দেন। অবশেষে অপারেশন হয়। কিন্তু এত দিন পরে অপারেশন হওয়ার ফলে তেমন কোনো লাভ হয়নি। আমার নার্ভে সমস্যা দেখা যায়। পরে হাসপাতাল থেকে আমাকে রিলিজ দেয়।’
অলি উল্লাহর এক্স-রে ফিল্ম
অলি উল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি বাড়িতে গিয়ে কিছু দিন কাটানোর পরে আবারও সাভার সিআরপিতে চিকিৎসা নিতে যাই। সেখানে সিআরপিতে ৩ মাস চিকিৎসা নিই। স্বপন এক দিনও দেখতে বা খবর নিতে আসেন নাই। এরপর আমি বাড়িতে চলে যাই। কিন্তু বাড়িতে যাওয়ায় পরেও অসুস্থ। আমার শরীরের পেছনের দিকে বড় বড় ঘা হয়ে গেছে। যে-কেউ সেই ঘা দেখলে তার চোখে পানি চলে আসবে। বাড়িতে যাওয়ার কিছু দিন পরে আমার বাবাও মারা গেছেন। আমি এমনি হতভাগ্য সন্তান বাবার লাশ দেখছি। কিন্তু লাশ কাধে নিতে পারি নাই। এটা যে কত বড় কষ্টের, বাবার লাশ সন্তান হয়ে ঘাড়ে তুলতে পারি নাই।’
ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমি থানা পুলিশের কাছে, চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু স্বপন বারবার আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি অনেক ক্ষমতাশালী। আমার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনসহ অনেক মানুষের সহযোগিতায় আমি একটা ঘা অপারেশন করেছি। তাতেই ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে৷ আরও একটা ঘা আছে। কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন, যেহেতু স্পাইনাল কটে আঘাত, তাই ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করালে হয়তো বা কিছুটা স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারব। সর্বশেষ গত শুক্রবার আবারও আমার শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় আমাকে কুমিল্লা পিপলস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’
কাঁদতে কাঁদতে অলি উল্লাহ বলেন, ‘আমি দুই পায়ে ভর দিয়ে মরতে চাই, কিছু একটা ব্যবস্থা করেন ভাই। মরার আগে দুই পায়ে ভর দিয়ে একবার দাঁড়াইতে চাই। কেউ কি আমার জীবনের এই চাওয়াটা পূরণ করতে এগিয়ে আসবেন না? আমার বাবা-মা বেঁচে থাকলে হয়তো বা তারা সন্তানের জন্য কিছু একটা করতো।’
যা বললেন সংশ্লিষ্টরা
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ওলি উল্লাহর মামা আবু সাঈদ বলেন, ‘আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। কিন্তু যখন গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল, তখনই যদি ভালো করে চিকিৎসা করা হতো তাহলে আমার ভাগ্নে এত দিনে ভালো হয়ে যেত। কিন্তু এখন ওর শারীরিক অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আর্থিক অবস্থাও ভালো না। তারপরও যতদূর সম্ভব আমরা চেষ্টা করছি। পৃথিবীতে এমন কেউ কি নেই যে, আমার ভাগ্নের চিকিৎসার দায়িত্বটা নিতে পারেন। যাতে সে সুস্থ হয়ে বাকি জীবন টা কাটাতে পারে।’
এই বিষয়ে ওই এলাকার ইউপি সদস্য বেল্লাল ভুঁইয়া বলেন, ‘ছেলেটার জন্য আসলেই খুব খারাপ লাগে। বাবা-মা কেউ নেই। তারপর শারীরিকভাবে পুরোপুরি অচল। আমরা সকলে চেষ্টা করে কিছু কিছু টাকা জোগাড় করে এত দিন ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু যে স্বপন ওকে গাছে তুলে দিয়েছিল, সেই স্বপন এখন আর কোনো খোঁজ-খবর নেন না। প্রথমের দিকে স্বপন কিছু দিন চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে, টাকাও খরচ করেছে। তবে এখন আর তিনি খোঁজ নিতে চান না। বিষয়টি নিয়ে একটা সমাধানের জন্য সালিসিতে স্বপনকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু স্বপন আসে নাই। এর বেশি কিছু তো আমরা করতে পারি না।’
অলি উল্লাহ বর্তমান চিকিৎসক ডা. কামরুল ইসলাম মামুন বলেন, ‘ওলি উল্লাহ গাছ থেকে পড়ে গিয়ে স্পাইনাল কটে আঘাত পেয়েছেন। এরপর তার দুই পা’ই প্যারালাইজড। গত রমজানে তার একটা চিকিৎসা করেছিলাম। এরপর বর্তমানে তার ফিজিওথেরাপি চলছে।’
তিনি বলেন, ‘আসলে পুরোপুরি সুস্থ হওয়াটা এই রোগীর জন্য অসম্ভব। তবে আমরা তাকে রিহেবিলিটেশন করছি। সে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থাতেই যাতে একটু চলাচলের চেষ্টা করতে পারে।’
অসুস্থ অলি উল্লাহর এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সেই স্বপন বলেন, ‘আমি তো তাকে গাছ থেকে ফেলে দেইনি। সে মনে হয় একটু অসুস্থ ছিল। গাছের অল্প কিছু উপরে উঠতেই সে মাটিতে পড়ে যায়। আমি তো তাকে হাসপাতলে নিয়ে গেছি। আমি তার চিকিৎসাও করিয়েছি। এখন আমি আর কি করতে পারি। অলি উল্লাহ এখনো খোঁজ-খবর আমি নিচ্ছি।’
সূত্র : দৈনিক আমাদের সময় অনলাইন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।