জুমবাংলা ডেস্ক : যৌনকর্মীর পেশা ছেড়ে হাজেরা বেগম নামে এক ত্রিশোর্ধ্ব নারী গড়ে তুলেছেন যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের জন্য এক আশ্রয়কেন্দ্র। একসময় পেশা ছেড়ে, যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের লেখাপড়া, খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন তিনি। নিজের জমানো পয়সা দিয়ে গড়ে তোলেন যৌনপল্লীতে জন্ম নেওয়া শিশুদের আশ্রয় কেন্দ্র।
হাজেরা বেগমের কথায় তিনি চান যৌনপল্লীতে জন্ম নেওয়া এই বাচ্চাগুলোকে যেন বাধ্য হয়ে তাদের তাদের মায়ের পেশায় না ঢুকতে হয়, অথবা অন্য কোনো অন্ধকার জগতের বাসিন্দা না হতে হয়।
ত্রিশোর্ধ নারীদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে বিবিসি বাংলার ধারাবাহিক ‘তিরিশে ফিনিশ’-এর এই গল্পটি হাজেরা বেগমের।
“আমার নাম হাজেরা বেগম। আমি এক সময় যৌনকর্মী ছিলাম। আর এখন যৌনকর্মীর বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করছি; তাদের লেখাপড়া করাচ্ছি। যেহেতু যৌনকর্মীর বাচ্চারা কোথাও লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে না।
‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনের মাধ্যমে এসব বাচ্চাদের লালন-পালন করছি। এটা শুরু করেছি ২০১০ সালের জুন মাসে। ২৫-২৬ জন বাচ্চা দিয়ে শুরু করেছি। যেহেতু আমাকে চিনে ওরা, বাচ্চার মায়েরা আমাকে বলে যে আপা আমরাতো লেখাপড়া করতে পারলাম না। আমাদের বাচ্চাদের একটু জ্ঞান-বুদ্ধি দেন।
সাত বছর বয়সে বাসা থেকে হারিয়েছি। আমার সৎ মা ছিল, খাবার দিতো না। খাবারের জন্য আমি বাসে উঠেছিলাম মিরপুর থেকে। দোতলা বাস ছিলো (উপরে) ঘুমিয়ে পড়েছি। বাস এসে থেমেছে জিপিও-তে আমিতো কিছু চিনি না। তখন রাস্তায় টোকাই বাচ্চাদের সাথে থাকতাম। পরে এক সময়, দশ বছর বয়সে এক মেয়ে ইংলিশ রোড পতিতালয়ে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে।
আমি ১৯৯০ সাল থেকে এই পেশাটা ছেড়ে দিয়েছি। এরপর আমি অন্যান্য কাজ করতাম, এনজিও-তে কাজ করেছি। তখন আমার মনে আসে যে যৌনকর্মীর বাচ্চাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। আর আমার তখন টাকা-পয়সা যা ছিলো সব খরচ হতো না, ব্যাংকে রাখতাম। পরে নয় লাখ টাকা দিয়ে বাচ্চাদের এই সেন্টারটা দিয়েছি।
বাচ্চা পাশে থাকে আর মা যৌন পেশায় থাকে। ফলে সে কাজটা বাচ্চাটা শিখে যাচ্ছে। ছেলে হলে সে টোকাই হয়ে যায়, ভিক্ষা করে। একটা মেয়ে বাচ্চা তার মায়ের জন্য কনডম কিনে রাখে। এ জিনিসটা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে। এটাতো ভয়ানক একটা ব্যাপার। মা কী কাজ করে সেটা মেয়েতো জানে, তার জন্য কনডমও নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এই মেয়েটার কী হবে?
স্কুলে ভর্তি করাতে প্রথমে সমস্যা হতো। আমরা তখন বেসরকারি যে স্কুলগুলো আছে সুরভী, ব্র্যাক এই স্কুলগুলোতে ভর্তি করাতাম। যখন ফাইভ পাশ করলো, তখন বিভিন্ন স্কুলগুলো এসে আমাদের কাছে বাচ্চা চাইলো। তখন আমরা বললাম যে, আপনারা তো জানেন এরা কাদের বাচ্চা? তখন ওরা বলে, আপা বিদ্যার দরকার ওরা বিদ্যা নিবে। কার বাবা কী কাজ করে, কে ভিখারির ছেলে, কে যৌনকর্মীর ছেলে এটা আমাদের জানার দরকার নেই।
আরবি বাংলা সব ধরনের পড়াশোনা এখানে করতে হবে। ওরা তো বাসায় যেতে পারবে না, এখানে পড়াশোনা করতে এখানে থাকবে, খাবে। মাঝে মাঝে মায়েরা এসে দেখা করে যাবে।
গত নয় বছরে কয়েকশো বাচ্চাকে পড়ালেখা ও হাতের কাজ শিখিয়েছি। কেউ গাড়ি ড্রাইভিং করে, কেউ আবার বিদ্যুতের কাজ করে। এসব কাজ করে তাদের মায়েদের সহযোগিতা করে, কারণ মায়ের বয়স হয়ে গেছে না?
এখন আমার খুব ভালো লাগে কারণ এতো বাচ্চার মা যে হবো আমি ভাবিনি। আমার যে নিজের বাচ্চা নেই, এটা কখনো অনুভব করি না। তারা এসে আমার পায়ের কাছে বসে থাকে। বলে মা, একটু আদর করে দুই নলা ভাত খাইয়ে দাওগো মা। অনেক দিন তোমার হাতে ভাত খাই না।
শিশুরা আমাকে মা বলে পরিচয় দেয়। বর্তমানে ৫০ জনের বেশি শিশু এখানে (হাজেরার তত্ত্বাবধানে) আছে। বিভিন্ন এনজিও এবং দাতাদের সহায়তায় এসব বাচ্চাদের লালন-পালন করছি। ১৮ বচর বয়সে ভবঘুরেদের শিক্ষা কেন্দ্রে লেখাপড়া শিখেছি। যৌনকর্মীর সন্তানদের আশ্রয় দিতে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ প্রতিষ্ঠা করেছি।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।