জুমবাংলা ডেস্ক : পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়ার শ্রমবাজার হাত ছাড়া হচ্ছে। দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর দু’বছর আগে রোমানিয়া হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। ঢাকায় কনস্যুলার সেবা কার্যক্রমও চালু করেছিল দেশটির সরকার। দেশটি থেকে ইউরোপে পালিয়ে যাওয়ার রুট বানিয়েছে অনেকে। বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মীরা ৭/৮ লাখ টাকা ব্যয় করে রোমানিয়ায় গিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। কারণ বাংলাদেশিরা ইউরোপে গিয়ে অবৈধভাবে তৃতীয় কোনো দেশে চলে যাচ্ছেন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রোমানিয়ার নিয়োগকর্তারাও। অসন্তুষ্ট রোমানিয়ার দূতাবাস ঢাকায় ভিসা ইস্যু করার কনস্যুলার সেবা ক’মাস আগে রাতের আঁধারে গুটিয়ে নিয়েছে। সহসাই আর দিল্লি থেকে ঢাকায় এই ভিসা ইস্যুর সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রোমানিয়া থেকে একটি ফ্লাইট যোগে ১৩ জন বাংলাদেশি কর্মীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে।
হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর কল্যাণ ডেক্সের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রতারণার শিকার এসব কর্মীদের ল্যাগেজসহ অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে একটি গাড়ি যোগে কাকরাইলস্থ বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলমের কাছে প্রেরণ করে। গুলশানের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গত ২৩ মে এসব কর্মী রোমানিয়ার সেন্টিরিল ন্যাভাল কনস্টান্টা সা শিপিয়ার্ডে চাকরি নিয়ে দেশটির রাজধানীর বিমান বন্দরে পৌঁছে। উক্ত কোম্পানী এসব কর্মীদের অপর একটি কোম্পানী এসসি জেসো’কনসেপ্ট এসআরএল এ ট্রান্সফার করে দেয়। দেশটির বিমান বন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশ উক্ত কোম্পানীকে বাংলাদেশি ১৩ জন কর্মীকে রিসিভ করার জন্য ডাকলে তারা এসব কর্মীর প্রয়োজন নেই বলে গ্রহণ করেনি। কর্মী আরিফুল ইসলাম ও গাজীপুরের সোহাগ দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশের হাত-পা ধরেও দেশটিতে প্রবেশ করার অনুমতি পায়নি। রোমানিয়া পুলিশ বিরক্ত হয়ে এসব বাংলাদেশিদের একই ফ্লাইটে তুলে ফেরত পাঠায়। রোমানিয়া ফেরত এসব বাংলাদেশি কর্মী আরিফুল ইসলাম, আশিস দাস, গাজীপুরের সোহাগ মিয়া, বাহাউল আলম, আবুল কালাম, চান মিয়া, মধু দাস, বাবুল মিয়া, হোসেন, মো. বাদল, রুবেল মো. আব্দুল হোসেন মোহা. জালাল উদ্দিন, মোশারফ হোসেন ও হাবিল ঢাকা বিমান বন্দরে পৌঁছে কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের কল্যাণ ডেক্স এর উপ পরিচালক রোমানিয়া ফেরত কর্মীদের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের গাড়ী যোগে কাকরাইলস্থ বিএমইটির মহাপরিচালকের কাছে পাঠিয়ে দেন। রোমানিয়া ফেরত এসব ক্ষতিগ্রস্ত কর্মী বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম এনডিসি’র কাছে অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় অথবা পুনরায় রোমানিয়ায় প্রেরণের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিত অভিযোগ পেশ করেন। এসব কর্মী চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এবং ভিটেমাটি বিক্রি করে অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিকে ৭/৮ লাখ টাকা করে দিয়ে স্বপ্নের দেশ রোমানিয়ায় গিয়েছিল। প্রতারিত হয়ে এসব কর্মী রোমানিয়া থেকে দেশে ফেরত আসায় গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনরা চরম হতাশায় পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোমানিয়ায় যাওয়ার পর বাংলাদেশি কর্মীদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণে দেশটির সরকার ঢাকার কনস্যুলার সেবা বন্ধ করে চলে গেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এদিকে, দেশটির শ্রমবাজার ধরে রাখতে কঠোর আইনের বাস্তবায়ন চায় বৈধ জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। কারণ বেশ কিছু বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি দেশটিতে দশ হাজারেরও বেশি কর্মী পাঠিয়েছে। এসব কর্মীর অধিকাংশই ইউরোপের অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছে। এতে সম্ভাবনাময় দেশটির নিয়োগকর্তারাও চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। অতিসম্প্রতি বায়রার সাবেক ইসির সদস্য ও এ্যাক্টিভ ম্যানপাওয়ারের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী এ অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রোমানিয়া থেকে বাংলাদেশিদের পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব না হলে দেশটির শ্রমবাজার স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি ইউরোপের সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার সম্প্রসারণে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ফের বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন রোমানিয়ায়। তবে কর্মী যাওয়া শুরু হতে না হতেই এই শ্রমবাজার নিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেছে। রোমানিয়ার জনশক্তি রপ্তানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত জনশক্তি রপ্তানিকারকদের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশিদের পালানো বন্ধ করার উপায় বের করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় এ ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। ফলে রোমানিয়ার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারল না বাংলাদেশ। বায়রার নেতা মোহাম্মদ আলী বলেন, অন্য দেশের ভ‚মি ব্যবহার করে অবৈধভাবে তৃতীয় একটি দেশে চলে যাওয়া ঘৃণ্য একটি অপরাধ। এর সঙ্গে দেশের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় শ্রমবাজারের পাশাপাশি ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে বাংলাদেশের। তিনি বলেন, পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়াতে ২০০৭-০৯ সাল পর্যন্ত বৈধভাবে শ্রমিক যাওয়া শুরু হয়। ২০০৯ সালের পর পরই বাংলাদেশি কর্মীদের পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতার কারণে রোমানিয়া সরকার দেশটিতে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন থেকেই বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে এই পালানোর প্রবণতা বন্ধ করার জন্য বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখন একমাত্র কঠোর আইনের মাধ্যমেই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে যেসব বৈধ এজেন্সি রোমানিয়াতে শ্রমিক পাঠানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবাইকে অবৈধ অভিবাসনের বিপক্ষে রুখে দাঁড়াতে হবে।
তবেই এই শ্রমবাজার ধরে রাখা সম্ভব হবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রোমানিয়া বাংলাদেশিদের জন্য ২০২০ সালে ৫৮০টি, ২০২১ সালে ২ হাজার ৮৬৯টি আর ২০২২ সালে ১২ হাজার ৯৬০টি ভিসা দিয়েছে। তবে সেখানে এখন অবস্থান করছেন মাত্র ৩ হাজার ৯৬ জন বাংলাদেশি। বেশির ভাগই রোমানিয়া থেকে তাদের কাজের মেয়াদ শেষ না করেই অন্য দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে রোমানিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিদের সূত্র জানায়, রোমানিয়ায় কাজের জন্য যাওয়া মোট বাংলাদেশিদের মাত্র ৫ শতাংশ এখন রোমানিয়ায় আছে। বাকিরা সবাই অন্য কোনো না কোনো দেশে চলে গেছেন। জানা যায়, রোমানিয়ায় অনেক কর্মীর চাহিদা রয়েছে। ২০২৩ সালে রোমানিয়া ১ লাখ কর্মী নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখসংখ্যক কর্মী বাংলাদেশ থেকে নিতেও আগ্রহী বলে জানিয়েছিল দেশটি। বিশেষ করে নির্মাণসহ অন্যান্য খাতে সেখানে কর্মীদের সুযোগ আছে রোমানিয়ায়। কাজের মেয়াদ শেষ না করেই বাংলাদেশিদের ইউরোপের অন্য দেশে পাড়ি দেওয়া নিয়ে ইতোমধ্যে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছে রোমানিয়া। বাংলাদেশে নিযুক্ত রোমানিয়ার অনাবাসি রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েলা সেজোনভ টেন ইতিপূর্বে ঢাকা সফরকালে অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ কর্মী রোমানিয়ায় পৌঁছে ইউরোপের অন্য দেশে চলে যান। এতে রোমানিয়া সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।