আন্তর্জাতক ডেস্ক: ভারতের মতো বিশাল দেশে অন্তত চারটি রাজধানী করে সে সব জায়গায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পার্লামেন্টের অধিবেশন করা উচিত বলে প্রস্তাব দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। খবর বিবিসি বাংলার।
ভারতের দক্ষিণ, উত্তর, পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে প্রান্তে চারটি রাজধানী করার কথা বললেও তিনি অবশ্য পশ্চিম ভারতের কথা উল্লেখ করেননি।
তবে পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচনের আগে তার এই প্রস্তাবকে প্রাদেশিকতার রাজনীতি উসকে দেওয়ার চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণেও এরকম একাধিক রাজধানী করার ভাবনাকে অবাস্তব বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ সাবেক আমলারা।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অবশ্য দৃঢ় বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতে প্রশাসনিক কাঠামো অতিরিক্তভাবে দিল্লি-নির্ভর এবং দিল্লির পাশাপাশি দেশের নানা প্রান্তে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাজধানী করা হলেই কেবল এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
শনিবার (২৩ জানুয়ারি) কলকাতায় সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তার এই ভাবনার রূপরেখা ব্যাখ্যা করেন মিস ব্যানার্জি।
তিনি সেখানে বলেন, আমি বলব ভারতের চারটে জায়গায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পার্লামেন্টের অধিবেশন করা হোক। আমরা সবার কথা ভেবেই এটা বলছি, কোনও সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা থেকে একথা বলছি না।
তিনি আরও বলেন, একটা (রাজধানী) দক্ষিণের তামিলনাডু, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ বা কেরালায় কেন হবে না? একটা উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, রাজস্থান কিংবা মধ্যপ্রদেশেও তো হতে পারে?
মিস ব্যানার্জি বলেন, আবার ধরুন পূর্বে বিহার-ওড়িশা-বাংলায়, কলকাতায় কেন হবে না? আর একটা (রাজধানী) ধরুন উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করেই বা কেন হবে না? আসলে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। ওয়ান নেশন, ওয়ান লিডার, ওয়ান রেশন কার্ড, ওয়ান পলিটিক্যাল পার্টি- এসব আবার কী?
মমতা ব্যানার্জির দাবি, এক দেশ-এক দল-এক নেতার ভাবনা থেকেও মুক্তি দেবে এই একাধিক রাজধানীর প্রস্তাব।
তবে ঘটনা হল, পৃথিবীতে ভারতের চেয়েও আকারে বড় দেশ রয়েছে (চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া) যারা কেবল একটিমাত্র রাজধানী দিয়ে দিব্বি কাজ চালাচ্ছে।
জোড়া রাজধানীও অবশ্য আছে নানা দেশে- যেমন দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রশাসনিক রাজধানী প্রিটোরিয়াতে, পার্লামেন্ট বসে কেপটাউনে, বিচারবিভাগীয় রাজধানী ব্লুমফন্টেইনে।
ভারতেও ১৯৩৯ সাল অবধি গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল হিমাচলের পার্বত্য শহর সিমলায়, ব্রিটিশ আমলে দিল্লির গরমে ভাইসরয় থেকে শুরু করে আমলা-সান্ত্রীরা পাড়ি দিতেন পাহাড়ে।
ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় সচিব ও অভিজ্ঞ আমলা টুকটুক কুমার অবশ্য আজকের যুগে এমন ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতেই রাজি নন।
মিস কুমার বলছিলেন, সোজা কথায় এটা একেবারে অবাস্তব ও যুক্তি-বুদ্ধিহীন একটা চিন্তা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যা খুশি বলে থাকেন, এটাও সেরকমই একটা প্রস্তাব। এটাকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনও কারণই নেই। প্রশাসনিক দৃষ্টিতেও এটা কত বড় সমস্যা তৈরি করবে ভাবুন তো?
তিনি জানান, দেশে আগে থেকেই প্রচুর সমস্যা আছে, সেগুলো সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। চারটে রাজধানী তৈরি করে আরও জটিলতা বাড়ানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলে মোটেই মনে করি না।
পশ্চিমবঙ্গে তিন মাসের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচন- তার আগে মমতা ব্যানার্জির এই প্রস্তাবে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে সেটাও সহজবোধ্য।
কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক অরুন্ধতী মুখার্জি মনে করছেন, রাজ্যে প্রতিবার ভোটের আগে দিল্লির বঞ্চনার ইস্যুকে খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা হয়, মমতা ব্যানার্জিও এই প্রস্তাবের ভেতর দিয়ে ঠিক সেটাই করতে চাইছেন।
মিস মুখার্জি বলছিলেন, বাংলা-বাঙালি বলে চেঁচামেচি, বাংলার জন্য অমুক করতে হবে তমুক করতে হবে- প্রতিবার ভোটের আগে এগুলো করা হয়। এটাও সেরকমই একটা প্রস্তাব।
তিনি বলেন, এরকম বিচিত্র তুঘলকি কান্ড তো ভাবাই যায় না। মমতা ব্যানার্জির সব কাজকর্ম না-হলেও এটাকে অবশ্যই মহম্মদ বিন তুঘলকের সিদ্ধান্তের সঙ্গেই তুলনা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আর ধরুন, দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইতে যদি রাজধানী করা হয় তাহলে ব্যাঙ্গালোর তো বলবে আমরা কী দোষ করলাম? তারাও খুব বড় শহর, মুম্বাইয়ের পর বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণও বটে। এমন কী সিউড়ি বা শিমোগা-র মতো শহরও তো বলতে পারে, জেলা শহরগুলোই বা কী দোষ করল?
অরুন্ধতী মুখার্জি বলেন, আর এটা তো সাধারণ করদাতাদের অর্থ দিয়ে সম্পূর্ণ বাজে খরচ। চারটে রাজধানীর বদলে যদি চারটে টিউবঅয়েল বসানো হয় বা চারটে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া যায় তাতে দেশের অনেক বেশি উপকার হবে।
ঠিক ১১০ বছর আগে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দিল্লিতে।
মমতা ব্যানার্জির প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কলকাতা আবার হয়তো বছরের কিছুটা সময় দেশের রাজধানীর গৌরব ফিরে পেতে পারত, কিন্তু আপাতত ভারতের নীতি-নির্ধারকরা সে প্রস্তাবকে একেবারেই আমল দিচ্ছেন না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।