বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : এ প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সহজ নয়। সেকালের বেশির ভাগ মানুষের একটা সহজ বিশ্বাস ছিল। সাগরের পানিতে আকাশের রং প্রতিফলিত হয় বলে সাগরের পানি নীল দেখায়। তাহলে রাতে কি সাগরের পানি নীল নয়? কিংবা মেঘলা দিনে? বিজ্ঞানীরা এটা ভেবেছিলেন কি না যায় না।
তবে বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীও একই ধারণায়ই বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু এক ভারতীয় বিজ্ঞানী অন্যভাবে ভাবলেন। তাঁর নাম চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন।
১৯২১ সাল।
ভেঙ্কট রামন তখন কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সে বছর যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেছে ইউনিভার্সিটি কংগ্রেস। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের নিয়ে সম্মেলন আর কি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অধ্যাপক গিয়েছিলেন সেই সম্মেলনে।
বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। আলাপ হয় নিজেদের গবেষণা নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে। তারপর বিজ্ঞান বক্তৃতা। সব শেষে ফেরত আসার পালা। রামনরা যে জাহাজে ফিরছেন, তার নাম এস এস নারকুণ্ডা।
অনেকটা পথ চলে এসেছেন। তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু জাহাজ একসময় এসে পড়ে ভূমধ্যসাগরে। এই সাগরের পানি আর দশটা সাগরের চেয়ে একটু বেশিই নীল। হঠাৎ রামনের মনে ওই প্রশ্নটা এসে যায়। সাগরের পানি নীল কেন?
এত দিন এটা নিয়ে মাথা ঘামাননি। কিন্তু সেদিন তার মনে হলো, এতদি ন যে কথা জানত মানুষ, তা ভুল। আর ওই তত্ত্বটা শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে। রামন কিছুতেই এই তত্ত্ব মানতে পারলেন না। তিনি পরীক্ষা করে দেখার কথা ভাবলেন।
তিনি প্রথম পরীক্ষাটা করলেন জাহাজে বসেই। কিছু একটা দিয়ে আড়াল করলেন সমুদ্রের কিছু অংশের পানি। তার পরে বিশেষ এক প্রিজম নিলেন। পানি থেকে প্রতিফলিত আলোর সামনে প্রিজম ধরলেন। প্রিজমের বিশেষ একটা বৈশিষ্ট্য আছে। আলোকে বিচ্ছুরিত করতে পারে।
আকাশের রং আড়াল হলে প্রিজমের নীল রঙের বিচ্ছুরণ হবে না। বিভিন্ন রঙের আলোর বিচ্ছুরণ একসঙ্গে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু রামন তাঁর পরীক্ষায় দেখলেন, সাগরের পানি নীল রঙেরই বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে। নিশ্চিত হলেন তাঁর ধারণাই ঠিক।
রামন জানতেন, এতটুকু পরীক্ষায় কাজ হবে না। নিজের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আরো গবেষণা প্রয়োজন। তিনি সমুদ্রের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন গভীরতার পানি সংগ্রহ করলেন। বোতলে ভরে নিয়ে এলেন নিজের গবেষণাগারে। নানাভাবে চলল গবেষণা। শেষমেশ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এলেন। দেখলেন ঠিক যে কারণে আকাশের রং নীল হয়, একই কারণে নীল হয় সাগরের পানিও।
বায়ুমণ্ডলের একটা স্তরে এসে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণ হয়। সূর্যের আলো সাত রঙের আলো দিয়ে তৈরি। বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ কমলা ও লাল। বাতাসের ওই স্তর পার হওয়ার সময় সব রঙের আলো নির্বিঘ্নে পার হয়ে আসে। কিন্তু নীল আলো বাধা পায়। বাতাসের অণুর কাছ থেকে। ফলে এর দিক যায় বদলে। আলাদাভাবে নীল আলো ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের ওই স্তরে।
রামন দেখলেন, একই রকম ঘটনা ঘটে সাগরের পানিতেও। সাগরের পানিতে লবণসহ নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এসব পদার্থের অণুতে বিচ্ছুরণ হয় সূর্যের নীল আলোর। তাই সাগরের পানির রং নীল হয়। একে যদি রাতের বেলা পরীক্ষা করেও একই ফল পাওয়া যাবে। এ জন্য করতে হবে একটা ছোট্ট পরীক্ষা। সাগরের পানিতে জোরালো সার্চ লাইটের আলো ফেলত হবে। পানি থেকে প্রতিফলিত আলো পরীক্ষা করলেই পাওয়া যাবে নীল রঙের বিচ্ছুরণ। রাতের আকাশের নীল রং প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ নেই। তাই সার্চলাইট থেকে পাওয়া নীল রংটা আসলে পানির নিজস্ব রং।
এই আবিষ্কারের সূত্র ধরে আরো বড় আবিষ্কার করে ফেলেন রামন। সেটার নাম রামন-কৃষ্ণান ইফেক্ট। এই আবিষ্কারের জন্য এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে রামন নোবেল পুরস্কার পান।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।