জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের বর্তমানে শুল্কমুক্ত সুবিধায় একটি গাড়ি দেশে আমদানি করার অনুমতি রয়েছে। তবে সম্প্রতি তাদের এই আমদানি করা গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। আগামী বাজেটেই এই প্রস্তাব করা হতে পারে।
অথচ সাধারণ নাগরিকদের একটি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে অনেক বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হয়।
প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কারা কারা করমুক্ত সুবিধা পান? কোন ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকেন তারা? কেনই বা দেয়া হয় এ ধরনের সুবিধা?
করযোগ্য আয় করলে আয়কর দিতে হয়। অর্থাৎ নিজে আয় করলে আয়ের একটি অংশ সরকারকে দিতে হয়। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিছু কিছু আয় আছে, যা করমুক্ত।
কোন কোন ভাতার ওপর কর দিতে হয় না?
আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরজনিত সুবিধার ওপর কোনো আয়কর দিতে হয় না।
পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, বাংলা নববর্ষ ভাতা ইত্যাদির ওপর কোনো কর পরিশোধ করতে হয় না। এছাড়াও বেশি কিছু খাত রয়েছে যেগুলোতে তাদের কর অব্যাহতি রয়েছে।
তবে আয়কর আইনজীবী মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘নির্ধারিত কর দিবসের মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা না দিলে করমুক্ত এসব সুবিধা বাতিল হবে। তখন এসব সুবিধার জন্যও তাদের কর দিতে হবে।’
এছাড়া সরকারি চাকরিজীবী করদাতা যদি চাকরির দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো বিশেষ সরকারি ভাতা, সুবিধা বা আনুতোষিক পান সেক্ষেত্রে সেটির জন্য কর দিতে হবে না।
করমুক্ত আয় করদাতার মোট আয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে না। এটি রিটার্নে করমুক্ত আয়ের কলামে প্রদর্শন করতে হবে।
আইনজীবীরা জানান, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে যেসব বিচারক নিয়োগ পান তারা ৩০ শতাংশ জুডিসিয়াল ভাতা পান। এই ভাতাও ট্যাক্স ফ্রি।
আয়কর আইনজীবী দিহিদার মাসুম বলেন, ‘উচ্চ আদালতের বিচারকদের বেতন ও বোনাস কোনো কিছুর ওপরেই এখন ট্যাক্স দিতে হচ্ছে না।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক এক সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, ‘প্রথমত, সরকারি কর্মকর্তারা যখন অবসরে যান তখন তারা একটা গ্রাচুইটি পান। এই গ্রাচুইটি ট্যাক্স ফ্রি। দ্বিতীয়ত, প্রভিডেন্ট ফান্ড যেটা তুলেন, যে ইন্টারেস্ট পান সেটাও ট্যাক্স ফ্রি। তৃতীয়ত, মাসিক যে পেনশন পান সেটাও ট্যাক্স ফ্রি। শুধু তাই নয়, এটা মোট আয়ের সাথেও যুক্ত হবে না। তার যদি অন্যান্য ইনকামও থাকে তাহলেও পেনশনের টাকাটা মোট আয়ের সাথে যুক্ত হবে না।’
আলমগীর হোসেন আরো বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা যে ভাতা পান তার জন্য ট্যাক্স দিতে হয়। রিটার্ন দেখাতে হয়। এক সময় ট্যাক্স ফ্রি ছিল। এখন আর তা নেই।’
তবে একসময় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনও করমুক্ত ছিল বলে জানান এনবিআরের সাবেক এই সদস্য।
তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো তাদেরও রিটার্ন সাবমিট করতে হবে। খুব সম্ভবত ৯১ এর পরে অথবা ৯৬ এর পরে সাধারণ মানুষের চাপে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সরকারি কর্মকর্তাদের ও রিটার্ন সাবমিট করতে হবে। তবে সেই ট্যাক্সটা সরকার দিয়ে দেবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এতে সরকার টাকা বরাদ্দ করতে। কয়েক বছর চলার পর আবার সিদ্ধান্ত হলো ট্যাক্সটা কর্মকর্তাকেই পে করতে হবে। পরে ওই সরকারি কর্মকর্তা বিল করে তা এজি অফিস থেকে তুলে নেবে। এটাও এক বছর চলল, পরে তা তুলে দেয়া হলো।’
আলমগীর হোসেন জানান, একটা পর্যায়ে সরকার সরকারি চাকরিজীবীরা নিজেরাই তাদের কর পরিশোধ করবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘বলা হলো, সরকার ওই অর্থ বরাদ্দ করবে না। সরকারি কর্মকর্তাদের ইনকাম ট্যাক্স তাদেরকেই দিতে হবে। এক পর্যায়ে এসআরও জারি হলো, সরকারি কর্মকর্তাদের শুধুমাত্র স্যালারি (বেসিক)ও বোনাসের ওপর ট্যাক্স দিতে হবে। অন্য যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা পেত তার ওপর ট্যাক্স দিতে হবে না।’
পরবর্তীতে ২০২৩ সালে যখন আইন করা হয় তখন সবার জন্য একই রকম বিধান করা হয় বলে মন্তব্য করেন আলমগীর হোসেন।
একইসাথে কেন সরকারি চাকরিজীবীরা এ সুবিধা পান তার ব্যাখ্যা দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু একসময় যখন প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচুইটি ট্যাক্স ফ্রি ছিল তাই সেটা এখনো আইন করে ট্যাক্স ফ্রি করা হয়। এই ধারা অব্যাহত আছে। সরকারের একজন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা যে পরিমাণ পেনশন পান সেটা ট্যাক্সেবল ইনকামের অনেক অনেক অনেক নিচে। তারা যদি সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ইনকাম পান সেটাও ফাইনাল সেটেলমেন্টের মধ্যে চলে যাবে। ইভেনচুয়ালি পেনশনের ওপর ট্যাক্স পেতে চাইলে সরকার আসলেই লাভবান হবে না।’
সরকারি চাকরিজীবীদের যে সকল কর দিতে হয়
আইনজীবীরা জানান, ২০২৩ সালের আয়কর আইন অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতন, উৎসব ভাতা, বোনাস (যে নামেই হোক না কেনো) তা করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
আয়কর আইনজীবী মাসুম বলেন, ‘এখানে উৎসব ভাতা বলতে দু’টি ঈদ উৎসব বা পূজাকে বোঝানো হয়েছে। বোনাস বলতে ইনসেন্টিভ বোনাস বোঝানো হয়েছে। অনেক সরকারি ব্যাংকে এই বোনাস দেয়া হয়। ২০১৫ সালের বেতন ভাতার আদেশ অনুযায়ী বেতন পেলে এর ওপর ট্যাক্স দিতে হবে। যদি কোন ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সম্মানী ভাতা পান অথবা কোনো সরকারি কর্মকর্তা কোনো ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়ে ভাতা পান তবে এটির ওপর আয়কর দিতে হবে।’
তবে শুল্ক দিয়েই সরকারি চাকরিজীবীদের গাড়ি আমদানি করতে হয়।
সাবেক কাস্টমস কমিশনার আব্দুল কাফি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য যেসব গাড়ি আমদানি করা হয় সেগুলোতে সব ধরনের ট্যাক্স দিতে হয়। শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট ও সংসদ সদস্যদের গাড়ি শুল্কমুক্ত আমদানি করা যায়। গাড়ির সিসির ওপর নির্ভর করে শুল্ক ডিফার করে। চার হাজার সিসির ওপর কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ৬০০ শতাংশও শুল্ক দিতে হয়। সিসি বাড়লে বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স ও বাড়ে।’
কারা করমুক্ত সুবিধা পান?
আয়কর আইন ২০২৩ এ কারা বিভিন্ন করমুক্ত সুবিধা পাবেন সে সম্পর্কেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের জারি করা ২০১৫ সালের চাকরি (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ অনুযায়ী বেতন হয় এমন সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের করমুক্ত বিভিন্ন সুবিধা পান।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিভিন্ন স্ব-শাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকরিজীবীরা করমুক্ত বিভিন্ন সুবিধা পান।
এছাড়াও কোনো আইন, বিধি বা প্রবিধানের অধীনে কোনো পদে নিয়োজিত থাকাকালীন সরাসরি সরকারি কোষাগার হতে বেতন বা আর্থিক সুবিধা যারা পাবেন তারা করমুক্ত সুবিধা ভোগ করবেন।
আন্তর্জাতিক সংস্থা বা আন্তঃসরকারি সংস্থায় কর্মরতদের অবস্থা
আইনজীবীরা জানান, ২০২৩ সালের আয়কর আইন অনুযায়ী, কোনো বৈদেশিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার, এনভয়, মিনিস্টার, চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স, কাউন্সিলর, দূতাবাসের উপদেষ্টা, হাই কমিশন, বৈদেশিক রাষ্ট্রে লিগেশন বা কমিশনে যারা চাকরি করেন তাদের আয়কর দিতে হয় না।
আয়কর আইনজীবী মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী রাষ্ট্রের ট্রেড কমিশনার বা অন্যান্য সরকারি প্রতিনিধি ওই পদে অবৈতনিক দায়িত্ব পালনকারী নয় এরূপ যে বেতন পান তাতে তাকে কর দিতে হয় না। আবার বাংলাদেশী নাগরিক নয় কিন্তু বিভিন্ন দূতাবাস বা বৈদেশিক কার্যালয়ে কর্মরত ব্যক্তি বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিক হলে তারাও কর অব্যাহতির অন্তর্গত।’
সাবেক কাস্টমস কমিশনার কাফি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রজেক্টের বিদেশী গাড়িগুলো যেগুলো বিদেশী ফান্ডে আসে সেগুলো ট্যাক্স ফ্রি। সরকারের সাথে যে চুক্তি থাকে সেটাতেই এটা এনবিআর উল্লেখ করে দেয়। কিন্তু সেটা বাংলাদেশে হস্তান্তর বা বিক্রি করলে ট্যাক্স দিতে হয়।’
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।