সারাদেশে ফার্মেসিগুলোতে ওষুধের দাম নিয়ে জনমনে অসন্তোষ

pharmacy

জুমবাংলা ডেস্ক : মাসে অন্তত ৫-৬ হাজার টাকার ওষুধ কেনেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আহমেদ হোসেন। উচ্চ রক্তচাপ, গ্যাস্ট্রিক এবং হৃদরোগের জন্য শুধু ওষুধের পেছনে তার ব্যয় হয় এই টাকা। তিনি জানান, ওষুধের পাশাপাশি টেস্ট, ডাক্তারের খরচ সব মিলিয়ে অনেক টাকা চলে যায় চিকিৎসার জন্য। একজন মানুষের আয়ের বেশিরভাগ যদি চিকিৎসায় চলে যায় সে চলবে কীভাবে। তার মধ্যে ওষুধের দাম কখনোই স্থিতিশীল ছিল না। কয়েক দিন পর পর দাম বাড়ে। এভাবে চলা খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, ওষুধের লাগাম যেন টেনে ধরা হয়।

pharmacy

গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, তার মধ্যে ওষুধও আছে। অধ্যাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে ওষুধের ওপর ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাট বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, যা ৯ জানুয়ারি থেকেই কার্যকর হয়েছে।

মূল্য স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাটসহ প্রতি একক ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারিত মূল্যের মধ্যে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ও আইনের তৃতীয় তফসিলের অনুচ্ছেদ (৩) অনুযায়ী ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২.৪ শতাংশ ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই ভ্যাট বেড়ে এখন ৩ শতাংশ করা হয়েছে। তাই ওষুধের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর তাতে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে জনমনে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সর্বশেষ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ চলে যায় ওষুধের পেছনে। মানুষ নিজের পকেটের ১০ দশমিক ১ শতাংশ খরচ করে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, রোগ নির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, ওষুধে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং চিকিৎসা সামগ্রীতে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য অন্য সব খাতে যে খরচ হয়, তার প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয় শুধু ওষুধের পেছনে।

ওষুধ বিক্রেতারা বলছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার পর কয়েক দফায় বেশ কিছু ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাট বাড়ানো হলে অতিরিক্ত অর্থ ক্রেতার পকেট থেকেই যাবে।

ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বিভিন্ন ওষুধের দাম। তার আগেও বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে। অবশ্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর তখন বলেছিল, এই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বছরখানেক আগের। সেটি সমন্বয় করা হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর জানিয়েছে, এখন তারা মাত্র ১০টি ওষুধের দাম বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে।

তবে বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে পাওয়া গেছে ভিন্ন চিত্র। ফার্মেসির বিক্রেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ইনফেকশন নিরাময়ের ওষুধের দাম বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ওষুধের দাম বাড়াতে হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে অনুমোদন নিয়ে তারপর বাড়াতে হয়। তবে নতুন ভ্যাট আরোপের পর সেটি কীভাবে আদায় হবে তা নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। তবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, ওষুধ কোম্পানির বাড়তি খরচ কমিয়ে ওষুধের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কাজ করা হচ্ছে।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা তাসলিমা দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। ওষুধের পেছনে ব্যয় নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মাসের খরচ বেড়ে গেছে বাজারে জিনিসপত্রের দামে। আগে যেখানে সাংসারিক খরচ ছিল ১০-১২ হাজার টাকা, সেটা এখন লাগছে ১৫ হাজার টাকার ওপরে। তার ওপরে ওষুধের দাম তো বাড়ছেই। আগে মাসের ওষুধের পেছনে খরচ ছিল ৩-৪ হাজার টাকা। সেটাও এখন ৫-৬ হাজার টাকার মতো লাগছে। তাহলে ওষুধ খাওয়া কি ছেড়ে দেবো?

এদিকে সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। সেখানে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।

সভায় অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন এবং রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রাখে ওষুধ। একসময় আমরা ৮০ ভাগ ওষুধ আমদানি করতাম, এখন দেড়শ’র বেশি দেশে আমাদের ওষুধ রফতানি করি। কিন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে গিয়ে রোগীরা যত খরচ করে, তার বেশিরভাগই যায় ওষুধের পেছনে। এজন্য আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্য কাঠামো তৈরি করতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন আগে অত্যাবশ্যকীয় একটি ওষুধের তালিকা করা হয়েছিল, যাতে ৯০ ভাগ মানুষের অসুখ হলে এগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। পরবর্তীকালে সেটি নানাভাবে সংযোজন হয়েছে। এটাকে হালনাগাদ ও ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা আমাদের মূল লক্ষ্য। কোন ওষুধগুলোর ক্ষেত্রে কোন মডেল আমরা বেছে নিতে পারি, সেটি দেখতে হবে।’

প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহই বিজয় দানের মালিক

সভায় ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান আবদুল মুক্তাদির বলেন, ‘বর্তমানে দেশে ওষুধের বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে যত কম টাকায় ওষুধ পাই, পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বিদ্যুৎ, কর্মীদের বেতনসহ প্রতিটি খাতে খরচ বেড়েছে। তবে আমরাও চাই মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ পাক। আমরা কোনও ওষুধের দাম বাড়াতে চাই না। সমাধান করতে চাইলে কারও কথায় নয়, ভেবে চিন্তে ডব্লিউএইচও’র অত্যাবশ্যকীয় তালিকা অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদ করা যেতে পারে। সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনও বিবাদ নেই। আমরাও দেশের মঙ্গল চাই। এ ব্যাপারে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো সরকারকে সহযোগিতা করবে।’