মো. আবদুল মজিদ মোল্লা: ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) পৃথিবীতে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবিদের অন্যতম। মহানবী (সা.)-এর স্নেহছায়ায় লালিত-পালিত এই সাহাবি ছিলেন আরবের বিখ্যাত বীর ও সেনাপতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক পদে নিযুক্ত করে তাঁর যোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। খায়বারের যুদ্ধের একপর্যায়ে মহানবী (সা.) তাঁর হাতে মুসলিম বাহিনীর ঝাণ্ডা তুলে দেন এবং তার সম্পর্কে বলেন, ‘আমি এই ঝাণ্ডা এমন ব্যক্তিত্বের হাতে তুলে দেব আল্লাহ যার মাধ্যমে বিজয় দান করবেন। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলও তাকে ভালোবাসেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩০০৯)
আলী (রা.)-এর খেলাফতের স্বল্প সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেলেও বিশুদ্ধ বিশ্বাস মতে তা খেলাফতের ৩০ বছরের অন্তর্ভুক্ত—যে সময়ের ব্যাপারে মহানবী (সা.) সাক্ষ্য দিয়েছেন। আলী (রা.) কারো হাতে কোনো কিছুর নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু গুণের বিবেচনা করতেন। নিয়োগ পাওয়ার এসব গুণ অর্জনের তাগিদ দিতেন। মালিক ইবনে হারিস আশতার নাখয়িকে মিসরের ‘ওয়ালি’ (গভর্নর) নিয়োগের সময় নিম্নোক্ত নির্দেশনা প্রদান করেন।
১. আল্লাহর ভয় : তিনি বলেন, আমি তোমাকে আল্লাহর ভয়, তাঁর আনুগত্য ও কোরআনে বর্ণিত নির্দেশগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দিচ্ছি।
২. প্রবৃত্তি দমন : নিজের প্রবৃত্তি দমন করো এবং যা তোমার জন্য বৈধ নয়, সে ব্যাপারে সংযত হও।
৩. মানুষের জন্য ভালোবাসা : অধীনদের জন্য অন্তরে দয়া, ভালোবাসা ও অনুগ্রহ সঞ্চার করো। তাদের সঙ্গে হিংস্র পশুর মতো আচরণ কোরো না যে তাদের জীবিকাকে গনিমত মনে করবে। তারা দুই শ্রেণিভুক্ত : এক. হয়তো তারা তোমার দ্বিনি ভাই, দুই. নয়তো তারা তোমার মতো মানুষ।
৪. সংযত আচরণ : ক্ষমতার প্রতাপ ও জৌলুসের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাদৃশ্য গ্রহণ কোরো না। আল্লাহ প্রত্যেক উত্পীড়ককে অপদস্থ করেন এবং প্রত্যেক দাম্ভিককে অসম্মানিত করেন।
৫. ন্যায়পরায়ণতা : আল্লাহ ও আল্লাহর বান্দাদের প্রতি ন্যায়বিচার করো। বিশেষত নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে। অধীনদের যদি তুমি স্বাধীন করে দাও, তবে তুমি অবিচারকারী বিবেচিত হবে। আর যে আল্লাহর বান্দাদের ওপর অবিচার করে, সে আল্লাহর প্রতিপক্ষ হয়ে যায়।
৬. ভালো মানুষ ও অপরাধী সমান নয় : তোমার কাছে যেন ভালো মানুষ ও অপরাধী সমান বিবেচিত না হয়। প্রত্যেকের সঙ্গে যথাযথ আচরণ করো।
৭. জনগণের সন্তুষ্টি অর্জন : জেনে রেখো! শাসক ও শাসিতের পারস্পরিক সুধারণার চেয়ে মূল্যবান কোনো অর্জন নেই। উত্তম শাসক সেই যে প্রজাদের প্রতি দয়া করবে, তাদের কষ্ট লাঘব করবে এবং সাধ্যের বাইরের কোনো কিছু তাদের ওপর চাপিয়ে দেবে না।
৮. মুসলিম রীতি ও ঐতিহ্য লালন : এই উম্মতের অগ্রগামীরা যে রীতিনীতি ও ঐতিহ্য (সভ্যতা-সংস্কৃতি) লালন করতেন, তার সযত্ন লালন করবে। কেননা তা আমাদের (সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়) বন্ধনকে দৃঢ় করেছে এবং উম্মতের অভিভাবকরা তা সমর্থন করেছেন।
৯. ক্ষতিকর প্রথা-সংস্কার পরিহার : অতীতে যেসব প্রথা ও সংস্কার ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে তা নতুন করে প্রচলন কোরো না। কেননা এতে প্রথা প্রচলনকারীরা উপকৃত হবে এবং তুমি এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
১০. সব স্তরের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক : জেনে রেখো! প্রজারা বহু স্তরে বিভক্ত। এক স্তর তোমাকে যেন অন্য স্তর থেকে বিমুখ করে না দেয় এবং যোগ্যতা অনুযায়ী তোমার ওপর সবার অধিকার রয়েছে।
১১. সত্যের ওপর অবিচলতা : সত্যের অনুসরণ তুমি নিজের ওপর আবশ্যক করে নাও এবং ধৈর্য ধারণ করো, তা তোমার জন্য সহজ হোক বা কঠিন।
১২. সামরিক বাহিনীতে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন : তুমি তোমার বাহিনীগুলোর জন্য যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করো। যে আল্লাহ, তাঁর রাসুল (সা.), তোমার ও সাধারণ সৈনিকদের বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি কল্যাণকামী। যে হবে আর্থিক লেনদেনে পরিচ্ছন্ন, জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ, ক্রোধের সময়ও ধীরস্থির, দুর্বলদের প্রতি দয়ালু, শক্তিশালীদের কাছে সম্মানিত, পক্ষপাতমুক্ত ও পরিশ্রমী। কোনো দুর্বলতা যার কাছে প্রশ্রয় পায় না।
১৩. অভিজাত শ্রেণিকে প্রশ্রয় না দেওয়া : অভিজাত শ্রেণির কোনো ছোট ব্যাধিকে বড় হতে দেবে না এবং কোনো বড় ব্যাধিকে ছোট করে দেখবে না।
১৪. কোরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান : কোনো বিষয় তোমাকে বিচলিত করলে বা তুমি সংশয়ে পড়লে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (কোরআন ও সুন্নাহ) শরণাপন্ন হও। কোরআন ও সুন্নাহর বিধানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দাও।
১৫. ন্যায়নিষ্ঠ বিচারক নিয়োগ : প্রজাদের ভেতর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে তুমি বিচারক নিয়োগ দেবে। কোনো পরিস্থিতিই যার ভেতর সংকীর্ণতা তৈরি করে না, কোনো পক্ষ যাকে প্রভাবিত করে না, সত্য জানার পর তা অনুসরণে যে কুণ্ঠাবোধ করে না।
১৬. প্রশাসনের ওপর নজরদারি : তুমি তোমার কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের কাজের প্রতি লক্ষ রেখো। তাদের নিয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করো। ভালোবাসার প্রভাবে (পক্ষপাতমূলক) কাউকে নিয়োগ দেবে না যে, সে কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। তাদের (প্রশাসন) ব্যাপারে বিশ্বস্ত ও পেশাদার গোয়েন্দা নিয়োগ দেবে। যারা তাদের কাজের ক্ষেত্রে সততা ও প্রজাদের প্রতি তাদের কল্যাণকামিতার সংবাদ দেবে।
১৭. নতুন সমস্যার সমাধানে ইজতিহাদ : তুমি অনুসরণ করবে পূর্ববর্তী ন্যায়বিচারকদের রায়, উপকারী প্রচলন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর আপনজনদের অনুসৃত পদ্ধতি ও কোরআনে বর্ণিত বিধি-বিধান। এসবের ভেতর যে সমাধান তুমি পাবে, তা অনুসরণ করবে এবং যা এই যুগে উদ্ভাবিত সে বিষয়ে তুমি ইজতিহাদ (কোরআন-সুন্নাহর ওপর ভিত্তি করে নতুন বিধান উদ্ভাবন) করবে। (আন-নাজমুল ইসলামিয়া ফি আসরি সাদরিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৬৯-৭০)
আলী (রা.)-এর উল্লিখিত উপদেশে সংক্ষিপ্তরূপে হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামে নীতিমালা প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষত সুশাসন ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় উপদেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ। যার মাধ্যমে শাসক ও শাসিত একটি স্বস্তিকর উন্নত জীবনের দিশা পেতে পারেন।
লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিসি), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।