মাহিনের চোখে আজও সেই একই প্রশ্ন—কেন গণিত ক্লাসে তার মনোযোগ ভেঙে যায় বারবার? দ্বিতীয় পিরিয়ডের পরেই পেটে জ্বালাপোড়া শুরু হয়, মাথা ঘোরে। টিফিনের সময় বন্ধুরা যে নুডলসের প্যাকেট নিয়ে আসে, সেগুলো খেয়ে সাময়িক তৃপ্তি মিললেও শেষবেলায় ক্লান্তি গ্রাস করে তাকে। মাহিনের মতো লক্ষ শিশুর প্রতিদিনের সংগ্রামের কেন্দ্রে রয়েছে একটি উপেক্ষিত ইস্যু: স্কুলে বাচ্চাদের স্বাস্থ্যকর খাবার। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ৩৮% শিশু খর্বকায়, ২২% শিশুর ওজন কম (বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০২২)। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়—একটি প্রজন্মের স্বপ্নের ওপর পড়ে থাকা অন্ধকারের ছায়া।
Table of Contents
স্কুলে বাচ্চাদের স্বাস্থ্যকর খাবার: শারীরিক-মানসিক বিকাশের ভিত্তিপ্রস্তর
যখন একটি শিশু সকালে ঘুম থেকে ওঠে, তার মস্তিষ্ক ও শরীরের জন্য জ্বালানি জোগানোর দায়িত্ব বর্তায় পুষ্টিকর সকালের নাশতার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের শহর ও গ্রামীণ এলাকার ৬০% স্কুলগামী শিশু প্রাতরাশ ছাড়াই ক্লাসে অংশ নেয় (ইউনিসেফ রিপোর্ট ২০২৩)। এই অভাব শুধু ক্ষুধার্ত পেটে সীমাবদ্ধ নয়—এটি সরাসরি প্রভাব ফেলে সৃজনশীলতা, স্মৃতিশক্তি ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর। ঢাকার গ্রিন হেরাল্ড স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক ড. ফারহানা আহমেদের পর্যবেক্ষণ মর্মস্পর্শী: “যেসব শিশু টিফিনে ফল বা ঘরে তৈরি স্যান্ডউইচ আনে, তাদের চোখে আলাদা উজ্জ্বলতা থাকে। তারা জিজ্ঞাসু, ধৈর্যশীল। অন্যদিকে প্যাকেটজাত স্ন্যাক্সে অভ্যস্তরা সহজেই অস্থির হয়ে পড়ে।”
গবেষণা প্রমাণ করে:
- পুষ্টিকর টিফিন পাচ্ছে এমন শিশুদের পড়ালেখায় মনোযোগ ৪০% বেশি (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন, ঢাকা)
- আয়রন ও ভিটামিন-বি সমৃদ্ধ খাবার স্মৃতিশক্তি বাড়ায় ২৫%
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার (যেমন: চিয়া সিড, আখরোট) মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশন শক্তিশালী করে
২০২৪ সালের শুরুতেই খুলনার এক প্রত্যন্ত গ্রামে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রমাণ করে পুষ্টির অভাবে শিক্ষার ক্ষতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে। কুমিরা গভর্নমেন্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ১১ জন শিক্ষার্থী একসাথে জ্ঞান হারায় ক্লাসরুমে। তদন্তে জানা যায়, সকালে অপর্যাপ্ত খাবার খেয়ে স্কুলে আসা ওই শিশুদের রক্তে শর্করার মাত্রা বিপজ্জনকভাবে নেমে গিয়েছিল। এই ঘটনা স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামের গুরুত্বকে জাতীয় আলোচনায় এনেছে।
অপুষ্টি বনাম স্থূলতা: দুই মেরুর সংকট মোকাবিলায় স্কুল ফুড পলিসি
“বাবা, আমি কি বার্গার খেতে পারি?”—এই সাধারণ প্রশ্নের পিছনে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ এক দ্বৈত সংকট। একদিকে, বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী ২৮% শিশু অপুষ্টির শিকার। অন্যদিকে, শহুরে স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার গত ৫ বছরে বেড়েছে ৭০% (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা)। এই দুই চ্যালেঞ্জের মূলে রয়েছে একই সমস্যা—স্কুলে বাচ্চাদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের অভাব।
দুই বিপরীত সংকটের মূল কারণ:
- অপুষ্টি: দারিদ্র্য, পুষ্টি সংক্রান্ত অজ্ঞতা, গ্রামীণ এলাকায় সুষম খাবারের প্রাপ্যতা সীমিত
- স্থূলতা: শহরে ফাস্ট ফুডের সহজলভ্যতা, স্কুল ক্যান্টিনে ভাজাপোড়া ও মিষ্টিজাতীয় খাবারের আধিপত্য
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি স্কুল অভিনব এক পদ্ধতিতে এই দ্বৈত সংকটের সমাধান খুঁজছে। তারা স্থানীয় কৃষকদের সাথে চুক্তি করে তরিতরকারি কেনে এবং স্থূলতায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের বাবা-মাকে বিনামূল্যে শাকসবজি দেওয়া হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সায়েমা ইসলামের ভাষ্যে, “একজন স্থূল শিশুর পরিবার পেয়ে যায় পুষ্টিকর খাবার, কৃষক পায় ন্যায্যমূল্য—একই প্রচেষ্টায় দুই সমস্যার সমাধান।”
স্কুলে পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে রোল মডেল: যা শেখা যায় সফল প্রকল্প থেকে
বাংলাদেশে স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামের সফলতা শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবেও সম্ভব। ২০২১ সালে নাটোরের লালপুরে শুরু হওয়া “পুষ্টির আলো” প্রকল্প আজ জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত। এখানে স্থানীয় নারীদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি প্রতিদিন ১,২০০ শিক্ষার্থীর জন্য রান্না করে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন মিড-ডে মিল। মেন্যুতে থাকে স্থানীয় উপাদানে তৈরি বিশেষ খাবার:
- মিষ্টিকুমড়ার হালুয়া (ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ)
- ছোলার ডাল ও সবজি খিচুড়ি (প্রোটিন ও ফাইবারযুক্ত)
- কাঁচা পেঁপের সালাদ (এনজাইম সমৃদ্ধ)
এই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া গেছে ৩টি মূল সূত্র:
- স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার: খরচ কমায়, তাজা উপাদান নিশ্চিত করে
- মা ও শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা: টেকসইতা বাড়ায়
- খাদ্য নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ: স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমায়
“প্রথমে শিশুরা কাঁচা পেঁপে দেখলে নাক সিটকাতো। এখন তারা বাড়িতেও বাবা-মাকে সালাদ বানাতে বলে!” — রুবিনা আক্তার, পুষ্টির আলো প্রকল্পের রান্না শাখার সমন্বয়কারী
অভিনব কৌশলে স্কুলে স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস গড়ে তোলা
শিশুদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে ক্লাসরুমের চেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে স্কুল গার্ডেন। রাজশাহীর একটি স্কুলে “বাগান থেকে প্লেট” প্রকল্প চালু হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা নিজেরা চাষ করছে টমেটো, গাজর, পালংশাক। বিজ্ঞান ক্লাসে শিখছে ফসলের পুষ্টিগুণ, গণিত ক্লাসে মেপে দেখছে উৎপাদনের হিসাব। এই হাতে-কলমে শিক্ষার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
বাস্তবায়নের সহজ কৌশল:
- “পুষ্টি পাসপোর্ট” কার্যক্রম: শিশুরা প্রতিদিন কী খাচ্ছে তা রেকর্ড করে, মাস শেষে “পুষ্টি দূত” খেতাব পায়
- ক্যান্টিন রিফর্ম: ঢাকার ডিপিএস স্কুলে জাঙ্ক ফুডের বিকল্প হিসেবে চালু হয়েছে মিষ্টি আলুর চিপস, মসুর ডালের কাটলেট
- প্যারেন্ট ওয়ার্কশপ: মাসে একবার অভিভাবকদের শেখানো হয় দামি নয়, পুষ্টিকর টিফিনের ১০টি রেসিপি
আইন ও নীতির ভূমিকা: জাতীয় স্তরে কী করা দরকার?
বাংলাদেশে জাতীয় স্কুল পুষ্টি নীতি ২০১৯ থাকলেও বাস্তবায়নে এখনও পিছিয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন:
- স্কুল ক্যান্টিনে জাঙ্ক ফুড নিষিদ্ধ করার আইনি কাঠামো জরুরি
- সরকারি স্কুলে মিড-ডে মিল প্রোগ্রাম জাতীয়ভাবে চালু করতে হবে
- পুষ্টি শিক্ষা বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
মালয়েশিয়া, ভারতের কেরালা ও ব্রাজিলের স্কুল ফিডিং মডেল থেকে বাংলাদেশ শেখার সুযোগ রাখে। ব্রাজিলে স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত খাবার স্কুলে সরবরাহের ব্যবস্থা শিশুপুষ্টি ও কৃষি অর্থনীতি—দুটোই সমৃদ্ধ করছে।
জেনে রাখুন
স্কুলে বাচ্চাদের স্বাস্থ্যকর খাবার কেন গুরুত্বপূর্ণ?
শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য দৈনিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ জরুরি। স্কুলে ৬-৮ ঘণ্টা সময় কাটানোর সময় পুষ্টিকর খাবার তাদের শক্তি জোগায়, মনোযোগ বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যকর স্কুল মিল নেওয়া শিশুদের পরীক্ষার ফলাফল গড়ে ১৮% ভালো হয়।
স্বাস্থ্যকর টিফিন বক্সে কী রাখবো?
সহজলভ্য ও পুষ্টিকর বিকল্প হতে পারে: ওটসের উপমা (কার্বোহাইড্রেট), সিদ্ধ ডিম/ছোলা (প্রোটিন), গাজর বা শসার স্লাইস (ভিটামিন), বাদাম (স্বাস্থ্যকর ফ্যাট)। রংবেরঙের ফল রাখলে শিশুর আগ্রহ বাড়ে। মনে রাখবেন, খাবারের বৈচিত্র্যই সম্পূর্ণ পুষ্টির চাবিকাঠি।
স্কুল ক্যান্টিনে কী পরিবর্তন আনা উচিত?
প্যাকেটজাত নুডলস, চিপসের বিকল্প হিসেবে চালু করা যেতে পারে ভেজিটেবল প্যাটিস, ফ্রুট সালাদ, ঘরে তৈরি কেক। ক্যান্টিনে “পুষ্টি স্কোরকার্ড” ঝুলিয়ে প্রতিটি খাবারের পুষ্টিমান জানানো যায়। শিক্ষার্থীদের ভোটে প্রতি মাসে “সেরা স্বাস্থ্যকর স্ন্যাক” নির্বাচন করা হলে অংশগ্রহণ বাড়ে।
দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য সমাধান কী?
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম জোরদার করতে হবে। “এক টাকায় পুষ্টি” প্রকল্পের মাধ্যমে বিত্তবানরা দরিদ্র শিক্ষার্থীর জন্য মিল কিনে দিতে পারেন। স্থানীয় এনজিও ও কৃষি বিভাগের সহায়তায় স্কুল গার্ডেন থেকে উৎপাদিত শাকসবজি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিতরণ করা যায়।
স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস গড়ে তুলতে স্কুল কী করতে পারে?
পুষ্টি সপ্তাহ পালন, রান্না কর্মশালা, পুষ্টি বিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। বিজ্ঞান মেলায় পুষ্টিকর খাবারের মডেল প্রদর্শনী, বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে “পুষ্টি গান” বা নাটক অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন শিক্ষকরা। ক্লাসে গল্পের মাধ্যমে পুষ্টির পাঠ দেওয়া যায়।
বাবা-মায়ের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
শিশুর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলায় পরিবার মুখ্য ভূমিকা রাখে। সন্তানের টিফিনে কী দিচ্ছেন, তা মনিটর করা দরকার। জাঙ্ক ফুডের ক্ষতিকর দিকগুলো গল্পচ্ছলে বোঝাতে হবে। বাড়িতে পুষ্টিকর খাবার রান্নায় শিশুকে সম্পৃক্ত করলে তার আগ্রহ বাড়বে। প্রতি রোববার সন্তানকে নিয়ে নতুন কোনো স্বাস্থ্যকর রেসিপি বানানোর চ্যালেঞ্জ নিন!
স্কুলে বাচ্চাদের স্বাস্থ্যকর খাবার শুধু পেট ভরার বিষয় নয়—এটি তাদের মেধার স্ফুরণ, স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার এবং জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর। মাহিনের মতো লাখো শিশু অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে প্রতিদিন হারাচ্ছে শেখার সুযোগ, হারাচ্ছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের চিকিৎসক, প্রকৌশলী, নেতা। তাদের প্লেটে যদি পুষ্টি না থাকে, তবে জাতির উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? অভিভাবক, শিক্ষক, নীতিনির্ধারক—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্কুলগুলোকে পুষ্টির দুর্গে পরিণত করুন। একসাথে কাজ করলে, একটি ফল বা এক বাটি ঘরে তৈরি খিচুড়িও বদলে দিতে পারে ভবিষ্যতের গল্প। আপনার সন্তানের টিফিন বক্স আজই বদলান, কিংবা স্কুলে পুষ্টি কর্মসূচি চালু করতে শিক্ষকদের সাথে আলোচনা শুরু করুন—ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই যুদ্ধে আপনিও সৈনিক হোন!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।