ঢাকার বসুন্ধরা রেসিডেন্সিয়াল এলাকার ৪৫ বছর বয়সী ব্যাংকার রফিকুল ইসলাম সকালে অফিসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, হঠাৎ তার ডান হাতের মুঠোয় কলম আটকে গেল। জিহ্বা জড়িয়ে গেল কথা বলতে। ভাগ্যক্রমে স্ত্রী সময়মতো লক্ষণ চিনতে পেরে তাকে অ্যাপোলো হাসপাতালে নেওয়ায় প্রাণ রক্ষা পেল। ডাক্তার বললেন: “উচ্চ রক্তচাপ আর কোলেস্টেরলের অবহেলা প্রায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল আপনাকে।” রফিকুলের মতো বাংলাদেশে প্রতি ৪ মিনিটে একজন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন (বাংলাদেশ স্ট্রোক সোসাইটি, ২০২৩)। আশার কথা হলো, স্ট্রোক প্রতিরোধের জীবনযাপন গড়ে তুলে ৮০% ক্ষেত্রেই এ বিপদ এড়ানো সম্ভব। শুধু সচেতনতাই নয়, আপনার প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাসই হয়ে উঠতে পারে সুস্থ ভবিষ্যতের সুরক্ষাকবচ।
স্ট্রোক: বাংলাদেশে কেন বাড়ছে এই নীরব ঘাতক?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ২০২৪ রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্ট্রোকে মৃত্যুর হার গত দশকে ৪২% বেড়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম ব্যাখ্যা করেন: “শহুরে জীবনের তীব্র গতি, ফাস্ট ফুডের প্রতি আসক্তি, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার অনীহার কারণে তরুণ থেকে মধ্যবয়সীরাও স্ট্রোকের শিকার হচ্ছেন।” দেশে প্রতি বছর ২ লাখেরও বেশি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে প্রায় ৩০% রোগীর বয়স ৫০-এর নিচে (জাতীয় স্নায়ুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ২০২৩)।
৫টি প্রধান ঝুঁকি যা আপনি আজই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন:
- উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): বাংলাদেশে ২১% প্রাপ্তবয়স্ক উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন (জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট)।
- ডায়াবেটিস: ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত (বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি)।
- ধূমপান ও তামাক: প্রতি ৪ জন পুরুষের মধ্যে ১ জন ধূমপায়ী (বিশ্ব তামাকবিরোধী জরিপ)।
- স্থূলতা: শহুরে নারীদের ৩৮% ও পুরুষদের ২৫% স্থূলতার শিকার (ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট)।
- অতিরিক্ত লবণ: দিনে ১ চা-চামচের বেশি লবণ স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৩% বাড়ায় (WHO গাইডলাইন)।
বাস্তব উদাহরণ: নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস কর্মী শেফালী আক্তার (৩৭) প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজের চাপে ফাস্ট ফুড খেতেন, রক্তচাপ ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ২০২২ সালে তার মিনি-স্ট্রোক হয়। এখন তিনি DASH ডায়েট মেনে চলেন (শাকসবজি, কম চর্বিযুক্ত দুধ) এবং সপ্তাহে ৫ দিন ৩০ মিনিট হাঁটেন। তার রক্তচাপ এখন নিয়ন্ত্রণে।
স্ট্রোক প্রতিরোধের জীবনযাপন গড়ে তোলার ৫ স্তম্ভ
১. খাদ্যাভ্যাসে বিপ্লব: বাংলাদেশি খাবারের স্বাস্থ্যকর রূপান্তর
“মাছ-ভাতই বাংলার প্রাণ, কিন্তু রান্নার পদ্ধতিতে বদল আনুন,” পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদ ড. ফারহানা মোবারক (ইনস্টিটিউট অফ নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস | স্বাস্থ্যকর বিকল্প (বাংলাদেশি) |
---|---|
সাদা ভাত (প্রতিদিন ৩ বেলা) | লাল চাল/কোদো ধানের ভাত (দিনে ১-২ বেলা) |
ভাজা মাছ/মাংস | শাকসবজি দিয়ে মাছের ঝোল/চাপ |
বাইরের তেলে ভাজা খাবার | ঘরে তৈরি বেকড/স্টিমড স্ন্যাক্স |
মিষ্টি ফল (আম, লিচু) অতিরিক্ত খাওয়া | পেয়ারা, জাম্বুরা, আমলকী |
সয়াবিন তেল | সরিষা/অলিভ অয়েল |
বাংলাদেশি সুপারফুডস: কালিজিরা, মেথি শাক, ডাঁটাশাক, ছোলার ডাল, ইলিশ মাছের ওমেগা-৩।
২. চলুন, নড়াচড়া করি: ব্যস্ত দিনেও ফিট থাকার কৌশল
- সকাল ১৫ মিনিট: ছাদে বা বারান্দায় দ্রুত হাঁটা (৫,০০০-৭,০০০ স্টেপ/দিন)
- অফিসে: প্রতি ১ ঘণ্টায় ৫ মিনিট হাঁটা, লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার
- সন্ধ্যায়: ইউটিউব থেকে বাংলা ইয়োগা টিউটোরিয়াল (অনলাইন স্বাস্থ্য প্লাটফর্ম “হেলদি বাংলাদেশ”)
- সপ্তাহান্তে: পরিবার নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন বা রমনা পার্কে হাঁটা
গবেষণা: সপ্তাহে ১৫০ মিনিট মাঝারি ব্যায়াম (হাঁটা, সাইকেল) স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৭% কমায় (আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন, ২০২৪)।
৩. মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা: শহুরে জীবনের জন্য অস্ত্র
বাংলাদেশ সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির ডা. রোকেয়া বেগম বলেন: “ট্রাফিক জ্যাম, অফিসের টার্গেট, পারিবারিক দ্বন্দ্ব—এই চাপ রক্তে কর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে স্ট্রোক ডেকে আনে।”
প্রাক্টিক্যাল টিপস:
- প্রাণায়াম: দিনে ২ বার ৫ মিনিট গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস (নাক দিয়ে শ্বাস নিন, মুখ দিয়ে ছাড়ুন)
- ডিজিটাল ডিটক্স: রাত ৯টা পর মোবাইল নোটিফিকেশন বন্ধ করুন
- সামাজিক বন্ধন: সপ্তাহে ১ দিন বন্ধু/আত্মীয়ের সাথে আড্ডা
- হবি: গান শোনা, গার্ডেনিং, মৃৎশিল্প
৪. নিয়মিত স্ক্রীনিং: অপরাধীকে চিনে রাখুন
পরীক্ষা | কখন করাবেন | আদর্শ মাত্রা (বাংলাদেশ) |
---|---|---|
রক্তচাপ | ৩ মাসে ১ বার | <১৪০/৯০ mmHg |
রক্তের সুগার | বছরে ১ বার (৪০+ হলে ৬ মাসে) | Fasting: <৫.৬ mmol/L |
কোলেস্টেরল | বছরে ১ বার (৩৫+ হলে) | LDL: <১০০ mg/dL |
ওজন (BMI) | মাসে ১ বার | ১৮.৫ – ২২.৯ kg/m² |
সাশ্রয়ী বিকল্প: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনামূল্যে পরীক্ষা (বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)।
৫. তামাক ও মদ্যপান: চিরতরে বিদায়
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের ডেটা বলছে: ধূমপায়ীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ২-৪ গুণ বেশি। গুল, জর্দা, সাদাপাতাও সমান ক্ষতিকর। মদ্যপান রক্তচাপ বাড়ায় ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ছাড়ার উপায়:
- নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (NRT)
- কাউন্সেলিং (জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট: ০১৭২১৩৩৩৪৪৪)
- পরিবারের সহযোগিতা
জরুরি অবস্থায় কী করবেন? FAST টেস্ট মনে রাখুন
- F (Face): মুখ বেঁকে গেছে? হাসতে বলুন
- A (Arm): হাত দুর্বল বা অবশ? দু’হাত তুলতে বলুন
- S (Speech): কথা জড়িয়ে যাচ্ছে? সাধারণ বাক্য বলতে বলুন
- T (Time): সময় নষ্ট না করে জাতীয় জরুরি স্বাস্থ্য সেবা (১৬২৬৩) বা নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করুন
প্রথম ৪.৫ ঘণ্টা স্ট্রোক থেরাপির গোল্ডেন আওয়ার (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গাইডলাইন)।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. স্ট্রোক প্রতিরোধের জীবনযাপন শুরু করতে কি বয়সের সীমা আছে?
কোনো বয়সসীমা নেই। ২০ বছর বয়স থেকেই রক্তচাপ, সুগার পরীক্ষা করা উচিত। তরুণদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও মানসিক চাপ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। জীবনযাপনে পরিবর্তন যত আগে আনবেন, সুফল তত বেশি পাবেন।
২. বাংলাদেশে স্ট্রোকের ওষুধ কি খুব দামি?
অনেক জরুরি ওষুধ (যেমন: Aspirin, Statins) সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে পাওয়া যায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে NCD (নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ) ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে পরামর্শ নিন।
৩. ঘরোয়া উপায়ে কিভাবে রক্তচাপ কমানো যায়?
প্রতিদিন ১ কোয়া রসুন, কলার পাতা বা পুদিনাপাতার রস, এবং লবণ কম খান। তবে এগুলো শুধু সহায়ক, ডাক্তারের পরামর্শ ও ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে। রক্তচাপ নিয়মিত মনিটর করুন।
৪. স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে কি করণীয়?
ঝুঁকি ৩০% বেশি হতে পারে। তাই:
- ৩০ বছর বয়স থেকেই বছরে ১ বার সম্পূর্ণ হৃদরোগ স্ক্রিনিং
- ধূমপান/মদ্যপান একদম নিষিদ্ধ
- LDL কোলেস্টেরল ৭০ mg/dL-এর নিচে রাখুন
- মানসিক চাপ কমানোর উপর বিশেষ জোর দিন
৫. হঠাৎ স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে কি খাওয়ানো যাবে?
কখনোই খাবার বা পানি দেবেন না। রোগী অজ্ঞান হলে শ্বাসনালীতে খাবার আটকে শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাকে একপাশে কাত করে শুইয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিন।
স্ট্রোক কোনো অদৃশ্য অভিশাপ নয়, প্রতিরোধের চাবিকাঠি আপনার হাতেই। রফিকুল ইসলাম আজ প্রতিদিন সকালে ৩০ মিনিট হাঁটেন, বাড়িতে কম লবণ দিয়ে খান, এবং ৬ মাসে একবার ফুল বডি চেকআপ করান। তার মতো হাজারো মানুষ প্রমাণ করেছেন—স্ট্রোক প্রতিরোধের জীবনযাপন শুধু কষ্টকর বিধি নয়, এটি প্রাণোচ্ছ্বল ভবিষ্যতের অঙ্গীকার। আজই শুরু করুন: একটি কলম দিয়ে লিখে ফেলুন আপনার আগামীকালের স্বাস্থ্য পরিকল্পনা। পরিবারের সবার সাথে শেয়ার করুন এই লেখাটি। মনে রাখবেন, আপনার একটু সচেতনতাই পারে একটি প্রাণ বাঁচাতে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।