ডা. মো. আহাদ হোসেন : ২০ অক্টোবর বিশ্ব অস্টিওপোরোসিস দিবস। অস্টিওপোরোসিসকে অনেকে ‘হাড় ক্ষয়’ বলে থাকে। প্রকৃতপক্ষে অস্টিওপোরোসিসে হাড়ের গঠন দুর্বল হয়ে যায়। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, হাড়ের ভেতরে অসংখ্য বড় ছিদ্র বা পোর তৈরি হয়। ফলে হাড় পাতলা হয়ে ভঙ্গুর হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে ৫০ বছরের ওপরে প্রায় এক কোটি মানুষ অস্টিওপোরোসিসে ভুগছে। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। এবারের দিবসের মূলমন্ত্র ‘ভঙ্গুর হাড়কে না বলুন’।
কেন হয়?
জন্মের পর থেকে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের শরীরের হাড় সুগঠিত ও মজবুত হতে থাকে। এরপর প্রতিবছর ১-১.৫ শতাংশ হারে হাড় ক্ষয়ের প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়। তবে এটি মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিক চক্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বা মেনোপজের পরে প্রথম পাঁচ বছর ৩ থেকে ৫ শতাংশ হারে হাড় ক্ষয় শুরু হয়। তাই বলা যায়, হাড়ক্ষয় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি এই হাড়ক্ষয়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, উপরন্তু কিছু হাড়ক্ষয়ের অতিরিক্ত ঝুঁকি রয়েছে এমন অবস্থা শরীরে দীর্ঘদিন চলতে থাকে তাহলে এটি ধীরে ধীরে অস্টিওপোরোসিস পর্যায়ে চলে যায়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট আকারে গ্রহণ করার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াকে ধীর করা যায়।
কারা অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকিতে থাকেন
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব বয়সের নারী ও পুরুষ অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। তবে এটি নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
নারীদের ক্ষেত্রে যাদের দ্রুত মাসিক চক্র শেষ হয়ে যায় বা মেনোপজ হয়।
যারা দীর্ঘমেয়াদি পেটের আইবিএস সমস্যায় ভোগেন।
যাদের কিডনি ও লিভারের রোগ রয়েছে তারা।
যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত।
যারা দীর্ঘমেয়াদি অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ করেন।
যারা বেশির ভাগ সময় বসে কাজ করেন বা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ অনেক কম করেন।
যারা দীর্ঘমেয়াদি ধূমপান করেন।
কিছু কিছু ওষুধ দীর্ঘমেয়াদি সেবনে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি রয়েছে। যেমন—স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ, প্রস্টেট ক্যান্সারের ওষুধ, দীর্ঘমেয়াদি অমিওপ্রাজল বা গ্যাসের ওষুধ।
অস্টিওপোরোসিস হলে কী হয়
অস্টিওপোরোসিস মূলত বাইরে থেকে দেখা যায় না। এর ফলে শরীরের হাড়ের ভেতরের গঠন দুর্বল হয়ে যায়। এতে হালকা আঘাতে হাড় ভেঙে যেতে পারে। চলতে ফিরতে আমরা যে স্বাভাবিক পড়ে যাওয়া বা হালকা আঘাত পেয়ে থাকি, সেটা থেকেও বড় ধরনের হাড় ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। যা পরবর্তী সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার কারণও হতে পারে। বিশেষ করে পা ও মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেলে বেশি কষ্টের কারণ হয়।
অস্টিওপোরোসিস হয়ে গেলে রোগী ব্যথা অনুভব করেন। অন্যান্য ব্যথা থেকে এই ব্যথা কিছুটা ভিন্ন হয়। যেমন—দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের ব্যথা বাড়ে। হাঁটাহাঁটি বা কাজের মধ্যে থাকলে ব্যথা কিছুটা কমে, তবে দীর্ঘক্ষণ হাঁটা বা দীর্ঘক্ষণ ভারী কাজ করলে পরবর্তী সময়ে ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক রোগী বলে থাকেন, সারা দিন শেষে যখন রাতে ঘুমাতে যান তখন শরীরে ব্যথা অনুভব করেন। ব্যথা সাধারণত সারা শরীরেই হয়, তবে কোমর ও পায়ে ব্যথা বেশি অনুভব হতে পারে।
অস্টিওপোরোসিসের সঙ্গে কারো ডায়াবেটিস বা থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে ব্যথার প্রকৃতি আরো বেড়ে যেতে পারে। যেহেতু এই রোগে ব্যথা শরীরের ভেতর থেকে বা হাড়ের গঠনগত কারণে হয়। সে জন্য অনেক পাওয়ারফুল ব্যথার ওষুধ খেলে সাময়িক ব্যথা কমলেও আবার ব্যথা হবে। ব্যথার প্রকৃতি অনুযায়ী চিকিৎসা না দিলে সম্পূর্ণ ব্যথা নিরাময় সম্ভব নয়।
কোন পরীক্ষার মাধ্যমে অস্টিওপোরোসিস বোঝা যায়
ডেক্সা স্ক্যান বা বিএমডি টেস্টের মাধ্যমে খুব সহজেই আমাদের শরীরের হাড়ের গঠন অ্যানালিসিস বোঝা যায়। যে কেউ এই পরীক্ষা করাতে পারেন। তবে এই পরীক্ষার খরচ একটু বেশি হওয়ায় এটা অনেকেই করান না। মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪০ বছরের পরে এই টেস্ট করা গেলে খুব সহজেই অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বোঝা যায়। তবে স্বাভাবিক একটি এক্স-রে অনেক সময় কষ্টের প্রসেসের প্রাথমিক ধারণা দিতে পারে।
কিভাবে অস্টিওপোরোসিস থেকে ভালো থাকা যায়
নিয়মিত কর্মক্ষম থাকা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে অস্টিওপোরোসিস ধীরগতি করা সম্ভব এবং দীর্ঘ মেয়াদে ভালো থাকা সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যায়ামের মাধ্যমে মেরুদণ্ডের হাড়ের ঘনত্ব ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
দীর্ঘমেয়াদি ধূমপান এড়িয়ে চলা, দীর্ঘমেয়াদি গ্যাসের ওষুধ না খেয়ে বরং মাঝখানে দু-এক মাস বিরতি দেওয়া। যারা দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ সেবন করেন তাদের ক্ষেত্রেও কিছু সময় বিরতি দিয়ে দিয়ে ওষুধ সেবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বয়স বাড়ার পাশাপাশি ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা খুবই জরুরি। ভিটামিন ডি মূলত আমাদের শরীরের ক্যালসিয়াম হাড়ে সন্নিবেশিত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ আমাদের স্বাভাবিক খাবারে ভিটামিন ডির উৎস নেই বললেই চলে। অনেকে মনে করে, সূর্যের আলো থেকেই ভিটামিন ডি পাওয়া যায়, কিন্তু সূর্যের আলো থেকে যে প্রক্রিয়ায় ভিটামিন ডি পাওয়া যায় সেই যথাযথ প্রক্রিয়া আমরা অনুসরণ করতে পারি না। এ জন্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪০ বছর বয়সের পর থেকেই সাপ্লিমেন্ট আকারে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ IU বা প্রতি সপ্তাহে ২০০০০ IU ভিটামিন ডি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে গ্রহণ করা যেতে পারে।
বয়স ৪০ পার হলে নারীর ক্ষেত্রে ভিটামিন ডির মাত্রা দেখে নেওয়া যেতে পারে। টেস্ট করা সম্ভব না হলে নিয়মিতভাবে ভিটামিন ডি গ্রহণ করলেও কোনো ক্ষতি নেই। কারণ ভিটামিন ডি শরীরে অতিরিক্ত থাকলে এটা সাধারণত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করে না।
বয়স বাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের দরকার আছে কি
এই প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন যে বয়স বেড়ে যাচ্ছে, অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম খেতে হবে কি না। অনেকেই নিজের ইচ্ছামতোই অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম নিতে থাকেন ওষুধ আকারে। মূলত আমরা যে খাবার খাই এতে বিভিন্নভাবে ক্যালসিয়াম রয়েছে। এ কারণে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গেই ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। তবে ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ কিছু খাবার রয়েছে, দুধ বা দুধ দিয়ে তৈরি খাবারে মূলত ক্যালসিয়াম বেশি থাকে। বয়স বাড়লে এই খাবারগুলো খাওয়া যেতে পারে। এতে ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ হওয়া সম্ভব।
ওষুধ আকারে বা সাপ্লিমেন্ট ক্যালসিয়াম গ্রহণ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করা যেতে পারে। সাপ্লিমেন্ট ক্যালসিয়াম লাগবে কি না সেটি এক্স-রে দেখে ধারণা করতে পারেন চিকিৎসক অথবা প্রয়োজনে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ দেখেও এ বিষয়টা নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু আমরা যে ক্যালসিয়াম শরীরে নিচ্ছি সেটাকে কাজে রূপান্তরিত করতে বা হাড়ে সন্নিবেশিত করার জন্য ভিটামিন ডি-র প্রয়োজন। ভিটামিন ডি স্বাভাবিক খাবারে পাওয়া যায় না। এ জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সাপ্লিমেন্ট আকারে ভিটামিন ডি গ্রহণ করা যেতে পারে।
সাপ্লিমেন্ট ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না
চিকিৎসক ক্যালসিয়াম সেবনের পরামর্শ দিলেও অনেকেই খান না। তারা মনে করেন, অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম খেলে কিডনিতে পাথর হতে পারে। তাদের এই ধারণার সঠিক ব্যাখ্যা আছে। মূলত আমরা ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খেলে ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ হয়। ক্যালসিয়াম শরীরে ঢোকার পরে সেটা কিডনিতে যেতে হলে অক্সালেটের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হয়। তাই আমরা ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ যে খাবার খাই সেগুলোর মধ্যে অক্সালেটমুক্ত খাবার গ্রহণ করলে কিডনিতে পাথর হওয়া আশঙ্কা থাকে না।
অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার যেমন—বাদাম, বিট, চকোলেট সয়ামিল্ক ইত্যাদি অতিরিক্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলেই ভালো। তবে এগুলো যে একেবারেই খাওয়া যাবে না, বিষয়টা এমন নয়। পরিমিত পরিমাণে বিরতি দিয়ে খেলে কোনো ক্ষতি নেই। আর সাপ্লিমেন্ট আকারে চিকিৎসকরা যে ক্যালসিয়াম দিয়ে থাকেন তাতে সাধারণত ক্যালসিয়াম অক্সালেট সমৃদ্ধ ক্যালসিয়াম দেওয়া হয় না। এ জন্য এতে কিডনিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দোকান থেকে নিজের ইচ্ছামতো ক্যালসিয়াম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণ থেকে কিডনিতে পাথর হওয়ার ভয় কমে যাবে।
ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার
ক্যালসিয়াম হাড়ের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। সাধারণ পরিস্থিতিতে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ৮০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন সুষম খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। দুধ, পনির ও অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার, ইয়োগার্ট, সয়ামিল্ক, সবুজ শাক-সবজি যেমন—ব্রকোলি, বাঁধাকপি ও ওকড়া, সয়াবিন, বিভিন্ন ধরনের মাছ ও কমলা ক্যালসিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস।
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
যেহেতু হাড় ক্ষয় আমাদের শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাই বয়সকালে অনেকেই এই হাড় ক্ষয়ের সমস্যায় ভুগতে পারেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে যদি কেউ অতিরিক্ত হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হয় তাহলে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাভাবিক চলাফেরায় জুতা বা কেডস ব্যবহার করতে হবে।
পড়ে যাওয়া থেকে নিরাপদ থাকতে বাথরুম পরিষ্কার রাখতে হবে এবং বাসায় চলাচলের জায়গা পরিষ্কার ও পিচ্ছিলমুক্ত রাখতে হবে।
উঁচু-নিচু জায়গায় চলাচল থেকে বিরত থাকতে হবে।
অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকে কাজ করা বা অস্বাভাবিকভাবে শরীরকে বাঁকিয়ে কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
বেশি দূরত্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে আরামদায়ক যানবাহন ব্যবহার করতে হবে। পাবলিক যানবাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে রোগীর সঙ্গে কোনো সাহায্যকারী থাকলে ভালো হয়।
লেখক : এমবিবিএস, বিসিএস, এমডি, এফআইপিএম (ইন্ডিয়া)
কনসালট্যান্ট ও ব্যথা বিশেষজ্ঞ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ফরিদপুর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।