আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দিনসাতেক আগে কানাডার ডওসন শহরের ইউকন ইউরেকা ক্রিক অঞ্চলে অবস্থিত এক সোনার খনির কর্মী অন্যান্য দিনের মতোই খননের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। খননের কাজে ব্যবহৃত ফ্রন্টলোডার ট্রাকটি সেই সময় হঠাৎ-ই কিছুতে আটকে যেতে তিনি কাজ থামিয়ে ওঁর বস ব্রায়ান ম্যাককহ্যানকে ডেকে আনেন।
ব্রায়ান ছুটে আসেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। খননস্থল পর্যবেক্ষণ করে তিনি যা খুঁজে পান, একটুও দেরি না করে সেই ছবি পাঠান জীবাশ্ম-বিজ্ঞানী ড. গ্র্যান্ট জা়জু়লার কাছে। ড. জা়জু়লা ছুটে আসেন খননস্থলে। ব্রায়ানের হস্তক্ষেপে খননকার্য স্থগিত ছিল এতক্ষণ।
খননস্থলে যা খুঁজে পান, তা দেখে ড. জা়জু়লা বলেন, আজ যা আবিষ্কার করেছেন খনির এই কর্মী, তা উত্তর আমেরিকায় জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খনির ওই কর্মী আসলে খুঁজে পেয়েছেন একটি উলি ম্যামথ শিশুর দেহ। না, জীবাশ্ম নয়। কানাডার বরফের মধ্যে কয়েকহাজার বছর ধরে সংরক্ষিত থাকা উলি ম্যামথের শিশুর দেহ খুঁজে পাওয়া গেল।
কানাডা, রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত বরফের স্তরকে বলে পার্মাফ্রস্ট। এখানে চিরস্থায়ীভাবে বরফের স্তর তৈরি হয়ে রয়েছে। অবশ্য বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, পার্মাফ্রস্টও ধীরে ধীরে গলতে আরম্ভ করেছে। অত্যন্ত শীতল হওয়ার দরুন, পার্মাফ্রস্টে প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহ হাজার হাজার বছর ধরে সংরক্ষিত থাকতে পারে, বিন্দুমাত্র পচন ছাড়াই।
সেই পার্মাফ্রস্টেই প্রায় পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশহাজার বছরের প্রাচীন উলি ম্যামথ শিশুর দেহ খুঁজে পেয়ে একই সঙ্গে বিস্মিত ও আনন্দে অভিভূত ড. জা়জু়লা বর্ণনা দিচ্ছেন এই উলি ম্যামথ শিশুর- “শি ইজ় পারফেক্ট অ্যান্ড শি ইজ় বিউটিফুল।” ড. জা়জু়লার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, এই উলি ম্যামথ শিশুটির একটি ছোট্ট শুঁড় রয়েছে, সঙ্গে রয়েছে ছোট ছোট দু’টি কান, একটি লেজ। শুধু তাই নয়, তার শুঁড়ের শেষ প্রান্তে আকর্ষের মতো একটি ছোট্ট অংশ রয়েছে, যাতে সে সহজে ঘাস খেতে পারে।
তবে উত্তর আমেরিকাতে প্রথম হলেও, এর আগে একবার উলি ম্যামথের দেহ খুঁজে পেয়েছিলেন জীবাশ্ম-বিজ্ঞানীরা, জানাচ্ছেন ড. গ্র্যান্ট জা়জু়লা। সেই অর্থে এটি পৃথিবীর বুকে পাওয়া দ্বিতীয় উলি ম্যামথের দেহ। এই শিশু উলি ম্যামথের নাম রাখা হয়েছে ‘নান চো গা’, আঞ্চলিক ভাষায় যার অর্থ বৃহৎ কোনও প্রাণীর ছানা।
জানা যাচ্ছে, এই ম্যামথটির দৈর্ঘ্য প্রায় একশো চল্লিশ সেন্টিমিটার। ২০০৭ সালের মে মাসে রাশিয়াতে যে উলি ম্যামথের সন্ধান পেয়েছিলেন গবেষকরা, তার দৈর্ঘ্যের থেকে নান চো গা-র দৈর্ঘ্য সামান্য বেশি।
ড. জা়জু়লার মতে ‘নান চো গা’ যখন মারা যায়, তখন তার বয়স মাত্র তিরিশ বা পঁয়ত্রিশ দিন। এই অঞ্চলের ভৌগোলিক গঠনের কথা মাথায় রেখে ড. জা়জু়লা জানাচ্ছেন, এই শিশু উলি ম্যামথটি পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে মারা গেছে। এবং যখন এই শিশুটি মারা যায়, তখন তুষার যুগ চলছে, জানাচ্ছেন জা়জু়লা। গবেষকদের মতে, মারা যাওয়ার আগে ঘাস খেয়েছিল এই উলি ম্যামথের শাবকটি। তার ক্ষুদ্রান্ত্রে পাওয়া যাওয়া ঘাস অন্তত সেরকমই প্রমাণ করছে। ড. জা়জু়লা জানাচ্ছে, ম্যামথের শাবকটি খুব সম্ভবত ওর মায়ের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়েই ঘাস খাচ্ছিল এবং জল পান করছিল। কিন্তু সেই সময়েই সে পাঁকে আটকে যায়, এবং কোনওভাবেই সেখান থেকে বেরতে পারেনি। তারপর খুব দ্রুতই পুরোপুরি পাঁকে ডুবে যায় শিশুটি।
ইউকনে ১৯৯৯ সাল থেকেই তুষার যুগ সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেছিলেন জীবাশ্ম-বিজ্ঞানীরা। এই ঘটনার কিছুদিন আগেই ড. গ্র্যান্ট জা়জু়লার তত্ত্বাবধানে ইউকনের ক্লনডাইক গোল্ড ফিল্ডে জীবাশ্ম সন্ধানের কাজ শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল, তুষার যুগের জীবাশ্মের সন্ধান করা। সেই সময়েই তাঁরা উলি ম্যামথের কাঁধের।কাছের হাড়, একটি অখণ্ড শুঁড় ও পায়ের হাড়ের জীবাশ্ম খুঁজে পান। এর পাশাপাশি স্টেপ বাইসন, তুষার যুগের ঘোড়া এবং কারাবু-র জীবাশ্মেরও সন্ধান পান। বাদ যায়নি তুষার যুগের খরগোশ বা সেই যুগেরই শেয়ালের হাড়ের জীবাশ্ম। ড. জা়জুলা ও তাঁর সহকর্মীরা বহুদিন ধরেই ক্লনডাইক অঞ্চলে তুষার যুগের প্রাণীদের জীবাশ্মের সন্ধান করছেন। এই জীবাশ্মগুলির বয়স দশ হাজার থেকে শুরু করে এক লক্ষ বছরের মধ্যে।
ইউকন অঞ্চলে একাধিক সোনার খনি রয়েছে এবং সেখানকার কর্মীরা বিগত একশো কুড়ি বছর ধরে বিভিন্ন জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছেন। এই জীবাশ্মগুলি যেন তুষার যুগের স্পষ্ট ছবি তুলে ধরে একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও।
ড. জা়জুলা জানাচ্ছেন, সোনার খনির কর্মীরাও বরাবরই সাহায্য করে এসেছেন জীবাশ্ম খোঁজার কাজে। তাঁদের সাহায্য ছাড়া তুষার যুগ সম্পর্কে গবেষণাকে এত দূর আনা সম্ভব হতো না। ড. জা়জুলা বিভিন্ন ধরণের জীবাশ্ম এ-যাবৎ খুঁজে পেয়েছেন এই অঞ্চলেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি প্রতিবার এসে নতুন কিছুর সন্ধান পান। এই উলি ম্যামথের শাবকের সন্ধান পাওয়ার ঘটনা যেন আবারও সেই কথাই প্রমাণ করল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।