আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যেগুলো দেখলে ওই সময় মানব নির্মিত কোনো স্থাপনা বলে বিশ্বাস করা কঠিন! কারণ, এসব স্থাপনার নির্মাণশৈলী একই সঙ্গে জটিল ও বিশাল। ফলে অনেকেরই ধারণা, মিশরের পিরামিড, পেরুর নাজকা রেখা, ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জ–এর মতো স্থাপনাগুলো নির্মাণের পেছনে হাত রয়েছে বহির্জাগতিক শক্তি বা এলিয়েনের!
মহাকাশের অন্য কোথাও বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনাকে বিজ্ঞানীরা একেবারে উড়িয়ে দেন না। অনেকে মনে করেন, এলিয়েনরা পৃথিবীতে এসেছিল, বা এখনো গোপনে এসে ঘুরে যায়!
তবে পৃথিবীতে এলিয়েনদের আগমন সম্পর্কে এখনো শক্ত কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। এমন প্রেক্ষাপটে প্রাচীনকালে মানুষের হাতে গড়া স্থাপনার অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতাগুলোর পৃথিবীর জটিল, রহস্যময় স্থাপনাগুলো নির্মাণে যেসব উপায় অনুসরণ করেছে, সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া!
এমন সাতটি স্থাপনার বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হলো, যেসব স্থাপনা নিয়ে মানুষের ধারণা যে, এগুলো এলিয়েনের হাতে তৈরি!
সাকসেহুয়ামান (Sacsayhuamán)
সাকসেহুয়ামান, প্রাচীন ইনকা সভ্যতার রাজধানী কুস্কোর বাইরে পেরুর আন্দিজ পর্বতমালায় অবস্থিত একটি দুর্গ। বিশাল বিশাল পাথর খোদাই করে এবং একত্রে স্তূপ করে জিগ’স পাজলের মতো জোড়া দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই দুর্গ। দুর্গটির এমন নির্মাণশৈলীর কারণে অনেকের ধারণা, বহির্জাগতিক বন্ধু বা এলিয়েনের সহায়তায় প্রাচীন সভ্যতার লোকেরা এটি নির্মাণ করেছে। প্রায় হাজার বছরের পুরোনো অবিচ্ছেদ্য পাথুরে দেয়ালে গড়া এই দুর্গ নির্মাণে ব্যবহৃত প্রতিটি পাথরের আনুমানিক ওজন ৩৬০ টন। দুর্গটি নির্মাণে পাথরগুলোকে প্রায় ২০ মাইলেরও বেশি দূরে থেকে বয়ে আনা হয়েছে।
এই দুর্গের নির্মাণশৈলী এখনকার মানুষের মধ্যে বিস্ময় জাগালেও এর সমাধান আছে ইনকা সভ্যতার বসতবাড়ি ও নিজেদের সুরক্ষায় দুর্গ নির্মাণের কৌশলের মধ্যেই। প্রকৃতপক্ষে সাকসেহুয়ামান ইনকাদের জটিল নির্মাণশৈলীর একমাত্র উদাহরণ নয়; একই ধরনের গাঁথুনিতে গড়া দেয়াল ইনকা সাম্রাজ্যজুড়েই বিদ্যমান, যার একটি রয়েছে কুস্কোতে। সেখানে একটি ১২ কোণযুক্ত পাথর খুব সতর্কতার সঙ্গে স্থাপন করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই অঞ্চলে পাথরের খনি থেকে সেটি শহরে পরিবহন করতে ব্যবহার করা দড়ি ও লিভার (উত্তোলক) সমন্বয়ে গড়া একটি কৌশলের খোঁজ পেয়েছেন। যা প্রমাণ করে বহির্জাগতিক কোনো কিছু নয়, মানুষই শক্তি এবং দক্ষতার ওপর নির্ভর করে গড়ে তুলেছিল এই স্থাপনা।
পেরুর নাজকা রেখা
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর রাজধানী লিমার প্রায় ২০০ মাইল দক্ষিণ–পূর্বে একটি উচ্চ এবং শুষ্ক মালভূমিতে ৮ শতাধিক দীর্ঘ, সোজা সাদা রেখা এলোমেলোভাবে খোদাই করা। যেন কোনো শিল্পী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পাথুরে বুকে এঁকে রেখেছে কোনো এক প্রাচীন সংকেত। এসব রেখার মধ্যে ধরা পড়ে মাকড়সা, বানর এবং হামিংবার্ডসহ ৩০০টি জ্যামিতিক আকার এবং আরও ৭০টি প্রাণীর মূর্তি। সবচেয়ে বড় আকারগুলো প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট জুড়ে প্রসারিত এবং আকাশ থেকে সবচেয়ে ভালো দেখা যায়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, নাজকা রেখাগুলো প্রায় দুই সহস্রাব্দের পুরোনো। রেখাগুলোর বয়স, আকার, ওপর থেকে দৃশ্যময়তা এবং রহস্যময় প্রকৃতির কারণে এগুলোকে প্রায়শই পৃথিবীতে এলিয়েনদের অন্যতম সেরা কাজের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আসলেই কি এটি এলিয়েনের তৈরি না মানুষের? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। নাজকা রেখাগুলো যে মালভূমিতে অবস্থিত, সেটি আয়রন অক্সাইড পাথরে আবৃত। এর নিচে রয়েছে চুনাপাথর সমৃদ্ধ মাটি। নাজকা লাইন তৈরি হয়েছে এই পাথুরে জমি খুঁড়ে। রেখাগুলো প্রায় চার থেকে ছয় ইঞ্চি গভীর।
নাজকা রেখাগুলো সম্পর্কে উনিশ শতকের শুরুর দিকে ধারণা ছিল, এসব নকশার সঙ্গে প্রাথমিকভাবে নক্ষত্রপুঞ্জের সংযুক্তি থাকতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, এই নকশাগুলো পানি ও উর্বরতা সম্পর্কিত ধর্মীয় আচার নির্দেশ করে। পানির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে সেরকম স্থানগুলোকে সংযুক্ত করতেই নকশাগুলো আঁকা হয়। প্রাচীন রুক্ষ্ণ, শুষ্ক পেরু অঞ্চলের কথা ভাবলে এ রকম সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এই নকশাগুলো কেবল আকাশ থেকেই দেখা যায় তা নয়, বরং আশপাশের বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশ থেকেও দেখা যায়।
মিশরের পিরামিড
মিশরের পিরামিড পৃথিবীর বিস্ময়কর স্থাপনাগুলোর একটি। দেশটির রাজধানী কায়রোর ঠিক বাইরে, গিজায়, মিশরের সবচেয়ে বিখ্যাত পিরামিডটি অবস্থিত। সাড়ে ৪ হাজার বছরেরও বেশি আগে নির্মিত, গিজার পিরামিডগুলো মূলত সমাধি, যেখানে রানি এবং ফারাওদের সমাধিস্থ করা হতো।
কিন্তু কীভাবে মিশরীয়রা এই স্থাপনাগুলো তৈরি করেছিল? পিরামিড লাখ লাখ পাথর কেটে তৈরি, যার প্রতিটির ওজন কমপক্ষে দুই টন। এমনকি আজকের ক্রেন এবং অন্যান্য নির্মাণ সরঞ্জাম দিয়েও ফারাও খুফুর পিরামিডের মতো বড় পিরামিড তৈরি করা কঠিন কাজ। আবার পিরামিডগুলোতে জ্যোতির্বিদ্যাগত আকৃতি–প্রকৃতিও দেখা যায়।
তাহলে কি মিশরের পিরামিডগুলো এলিয়েনদের নিদর্শন? ঠিক, তা নয়। এটা সত্য যে, প্রাচীন মিসরীয়রা কীভাবে পিরামিডগুলো তৈরি করেছিল এবং এত দ্রুত তা করেছিল, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। তবে এই সমাধিগুলো যে হাজার হাজার মানুষের হাতে তৈরি সেটির অনেক প্রমাণ আছে।
স্টোনহেঞ্জ
অনেকগুলো পাথর বিশাল বৃত্তাকারে সাজানো, এর মধ্যে কিছু পাথরের ওজন ৫০ টন পর্যন্ত, স্টোনহেঞ্জ নামের এমন এক স্থাপনা দাঁড়িয়ে আছে ইংল্যান্ডের উইল্টারশায়ারে। সুইস লেখক এরিখ ভন ডেনিকেন স্থাপনাটি সম্পর্কে বলেছেন, এটি সৌরজগতের একটি মডেল যা এলিয়েনদের ল্যান্ডিং প্যাড হিসেবেও কাজ করে! প্রশ্ন জাগে এই বিশাল পাথরগুলোকে কয়েকশ মাইল দূর থেকে এনে কীভাবে এখানে স্থাপন করা হয়েছে?
স্টোনহেঞ্জ স্থাপনাটি ঠিক কী অর্থ বহন করে তা এখনো পরিষ্কার নয়। স্টোনহেঞ্জের পাথরগুলো নক্ষত্রমণ্ডল এবং সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে এর সঙ্গে এলিয়েনের যে সম্পর্ক নেই সেটি নিশ্চিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় ৫ হাজার বছর আগের এমন একটি স্থাপনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা আসলেই সম্ভব।
তিওতিহুয়াকান (Teotihuacán)
তিওতিহুয়াকান শব্দের অর্থ দেবতাদের শহর। এটি মেক্সিকোর বিস্তৃত প্রাচীন একটি শহর। শহরটি পিরামিড আকৃতির মন্দির এবং জ্যোতির্বিদ্যাগত কনফিগারেশনের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। দুই হাজার বছরেরও বেশি আগে নির্মিত, তিওতিহুয়াকানের বয়স, আকার এবং নির্মাণশৈলীর কারণে এটিকে অনেকেই অন্য জগতের কারও নির্মিত বলে দাবি করে। আসলে এটি মানুষেরই কাজ।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, মায়া, জাপোটেক এবং মিক্সটেকসহ বিভিন্ন সভ্যতার মিথস্ক্রিয়ায় এই শহর গড়ে ওঠে। যেখানে ১ লাখেরও বেশি লোক বসবাস করত। তিওতিহুয়াকানে পাওয়া ম্যুরাল, বিভিন্ন সরঞ্জাম, পরিবহন ব্যবস্থা এবং উন্নত কৃষি পদ্ধতির কারণে শহরটিকে প্রাক–আজটেক মেক্সিকোর চেয়ে প্রযুক্তিগতভাবে অনেক বেশি উন্নত বলে মনে করা হয়।
ইস্টার আইল্যান্ড
দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ চিলিতে অবস্থিত ইস্টার আইল্যান্ড আরেকটি স্থাপনা, যেটি ধারণা করা হয় এলিয়েনদের তৈরি। মৃত আগ্নেয়গিরির পাশে পাথর খোদাই করে বানানো প্রায় ৯০০টি মানবাকৃতির মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মূর্তিগুলো গড়ে ১৩ ফুট লম্বা ও ১৪ টন ওজনের। এগুলো ছাড়াও ৪০০ টির বেশি মূর্তি নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
ধারণা করা হয়, ধর্মীয় কারণে এই অঞ্চলের বাসিন্দারাই এসব ভাস্কর্য বানিয়েছিল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।