সম্প্রতি প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনের ‘জ্যামিতিক আকার’ মেপেছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ মিনগু ক্যাঙ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ সানজেই কিমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞানীদের একটি দল গবেষণাটি করেন। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে গবেষণাপত্রটি নেচার ফিজিকস জার্নালে প্রকাশিত হয়। গত ১৩ জানুয়ারি এ গবেষণা নিয়ে একটি বিস্তারিত নিবন্ধ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট, অর্থাৎ এমআইটি নিউজ।
পদার্থদের অতি খুদে মৌলিক কণাদের একটি ইলেকট্রন। পরমাণুর নিউক্লিয়াস তথা প্রোটন-নিউট্রনকে ঘিরে এদের বিচরণ। পরমাণু গঠনে ইলেকট্রনের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা সবাই জানি। ইলেকট্রনকে কণা বলা হলেও এরা তরঙ্গের মতোও আচরণ করে। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যায় এ অবস্থাকে বলা হয় ওয়েভ-পার্টিকেল ডুয়েলিটি বা কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা।
আমাদের বাস্তব জীবনে পদার্থবিজ্ঞান যেভাবে কাজ করে, পরমাণুর ক্ষুদ্রতম অঞ্চলে সেভাবে কাজ করে না। সেখানে নানা অদ্ভুত নিয়ম-কানুন দেখা যায়, কারণ পদার্থের খুদে কণাগুলো উদ্ভট সব কাজকর্ম করে। এই নিয়ম-কানুন এবং এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকেই আমরা ‘কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা’ বলি। এরকম উদ্ভট কাজকর্মের একটি হলো ইলেকট্রনের (বা যেকোনো কণার) কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা।
সব সময় গতিশীল থাকায় এ কণাগুলোর তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আবার কণা হিসেবে এদের আলাদা বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য কোয়ান্টাম স্তরে আলাদা করে দেখা যায় না। বরং একসঙ্গে দেখা যায়। এটাই কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা। বলে রাখা প্রয়োজন, এই কণা-তরঙ্গ দ্বৈততার কারণে ইলেকট্রণকে কণা হিসেবে ব্যাখ্যার চেয়ে তরঙ্গ হিসেবেই ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
এর নানা আচার-আচরণ তাতে সহজে ও ভালোভাবে বুঝতে পারেন বিজ্ঞানীরা। এ জন্য তাঁরা একধরনের গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বিজ্ঞানীদের ভাষায় একে বলা হয় ‘ওয়েভ ফাংশন’। এগুলো আসলে একধরনের গাণিতিক মডেল। ইলেকট্রনের কথাই ধরুন। এ কণার গতিপথ হিসেবে যদি তরঙ্গকে ভেবে নিই, তবে এই তরঙ্গের নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় সুনির্দিষ্ট কোনো বৈশিষ্ট্যযুক্ত কণা (বা ইলেকট্রন) পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, তা ব্যাখ্যা করে ‘ওয়েভ ফাংশন’ নামের গাণিতিক মডেল। এবারে বুঝে দেখা যাক, সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আসলে কী করলেন।
বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রনের ‘জ্যামিতিক আকার’ বলতে মূলত এর ‘কোয়ান্টাম জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য’ আরও নিখুঁতভাবে পরিমাপ করেছেন। এর গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে কোয়ান্টাম জিওমেট্রিক টেনসর বা কিউজিটি (QGT)। আসলে বিষয়টা হলো, নতুন এ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আমরা কণা হিসেবে ইলেকট্রনকে যেমন ছোট ছোট ‘খুদে গোলক’ হিসেবে কল্পনা করি, আদতে ইলেকট্রন মোটেও সেরকম নয়। তরঙ্গ হিসেবে ভাবলে, এর বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনো কোনোটিকে একধরনের জ্যামিতি বা জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য ভাবা যেতে পারে।
গোলকের একটি বৈশিষ্ট্য যেমন এর বক্রতা, সেরকম। আবার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যকে সাধারণ জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য বলা যাবে না। এগুলোকে বলতে হবে কোয়ান্টাম জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য। পদার্থের ল্যাটিস বা আণবিক ক্রিস্টাল কাঠামোতে থাকা ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম জ্যামিতি ঠিক সেরকম। এগুলো অনেকটা ‘ক্লেইন বটল’ বা ‘মোবিয়াস স্ট্রিপে’র মতো জটিল আকারের। ঊর্ধ্বকমার মধ্যকার শব্দগুলোকে লিখে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এগুলো একধরনের প্রান্তহীন অসীম কাঠামো। বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে নিচের ছবিটি দেখতে পারেন।
গবেষকদলের দাবি, ইলেকট্রনের বৈশিষ্ট্য এর আগে কখনো এত নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা হয়নি। কোয়ান্টাম জিওমেট্রিক টেনসর বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে কোয়ান্টাম পর্যায়ে একটা কণার বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। অনেকটা ত্রিমাত্রিক স্থানকে দ্বিমাত্রিক পর্দায় হলোগ্রাম করে দেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়, সেভাবে।
অ্যাঙ্গেল-রিজলভড ফোটন এমিশন স্প্রেক্ট্রোকপি পদ্ধতিতে ধাতব পদার্থের ওপর ফোটন বা আলোর কণা দিয়ে আঘাত করে ইলেকট্রনকে স্থানচ্যুত করার মাধ্যমে এর পোলারাইজেশন, স্পিনসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করেন বিজ্ঞানীরা। এ গবেষণায় ধাতব পদার্থ হিসেবে কোবাল্ট-টিনের সংকর ধাতু বেছে নেওয়া হয়। এর আরেক নাম কাগোম মেটাল। এটি মূলত একটি কোয়ান্টাম ম্যাটেরিয়াল। যেসব পদার্থের আচরণ চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান এবং লো-লেভেল কোয়ান্টাম মেকানিকস দ্বারা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না, সেগুলোকে কোয়ান্টাম ম্যাটেরিয়াল বলা হয়। বিজ্ঞানীদের এই দলটিই এর আগে কাগোম মেটালের কোয়ান্টাম জিওমেট্রি টেনসর নির্ণয় করেছিলেন। এবার একই পদার্থের ইলেকট্রনের কিউজিটি নির্ণয় করলেন তাঁরা।
কনডেন্স বা ঘনীভূত পদার্থের পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক সময়ের নানান জটিলতা ব্যাখ্যা ও অগ্রগতির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এই কোয়ান্টাম জ্যামিতি। নেচার ফিজিকস জার্নালের সঙ্গে আলাপচারিতায় এক মন্তব্যে এ কথাই বলেছেন এক বিশেষজ্ঞ। তাঁর নামটি অবশ্য প্রকাশ করা হয়নি। বর্তমানে শুধু কোবাল্ট-টিনের সংকর ধাতুতে ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম জ্যামিতি নির্ণয় করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন পদার্থের ইলেকট্রনের কিউজিটি বের করার ইচ্ছা আছে গবেষকদের।
তাঁরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে পদার্থের দারুণ সব ব্যবহারিক প্রয়োগ করা যাবে। প্রকৃতিতে খুব সহজে সুপার কন্ডাক্টর বা অতিপরিবাহী পদার্থ পাওয়া যায় না। অতিপরিবাহী পদার্থ আবিষ্কার বা সংশ্লিষ্ট গবেষণার পথ সহজ হবে নতুন এ আবিষ্কারের হাত ধরে। তা ছাড়া, বিজ্ঞানী দলটির আবিষ্কৃত এ পদ্ধতি সলিড স্টেট ম্যাটেরিয়ালের বিভিন্ন কোয়ান্টাম ঘটনা বুঝতে ও এ সংক্রান্ত নতুন গবেষণার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।