লাইফস্টাইল ডেস্ক : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ‘স্বাস্থ্য’ হচ্ছে – রোগহীন অবস্থায় শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ থাকা। শরীরের সঙ্গে মন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুস্থ শারীরিক স্বাস্থ্য মানে একটি রোগমুক্ত শরীর, আর সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য মানে ভয়, হতাশা, বিষণ্নতা এবং যেকোনো মন খারাপের পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকা। মানসিক স্বাস্থ্য মূলত তিনটি মৌলিক উপাদান অর্থাৎ মানুষের চিন্তা, আবেগ এবং আচরণের সমন্বয়ে গঠিত।
গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসব- পরবর্তী সময়ে প্রতিটি নারীই কম-বেশি মানসিক চাপে থাকেন। এই বিষয়টি যতটা গুরুত্বের দাবিদার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
এ সময়ের মানসিক সমস্যা
১. গর্ভকালীন বা প্রসব-পরবর্তী সময়ে নারীর শরীরে বিভিন্ন হরমোনের মাত্রার ব্যাপক তারতম্য ঘটে। এর প্রভাবে নারীর দেহ ও মনের সার্বিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটে।
২. গর্ভস্থ শিশুর বেড়ে উঠা, নিরাপদ প্রসব, নিজের স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে গর্ভবতী নারীর মনে এক ধরণের অনিশ্চয়তা বোধ কাজ করে। তাঁর মনের ভেতরে কিছুটা ভীতির সঞ্চার ঘটে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট, প্রসবকালীন নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, প্রসবকালীন বা প্রসব-পরবর্তী সময়ে সাহায্যকারী লোকজনের অভাব ইত্যাদি নিয়েও দুশ্চিন্তা থাকেন।
৩. অনেক দিন পর গর্ভধারণ, পূর্বের গর্ভপাত বা জন্মগত ত্রুটিযুক্ত শিশুর ইতিহাস থেকে থাকলে নারী তার গর্ভস্থ শিশুকে নিয়ে মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপে থাকেন।
৪. আগে দুইটা কন্যা সন্তান থাকলে, গর্ভের শিশুর লিঙ্গের বিষয় হবু মাকে অনেক প্রভাবিত করতে পারে।
৫. গর্ভাবস্থায় কর্মজীবী বা গৃহবধূ উভয় ধরণের নারীর ক্ষেত্রে পরিমিত বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। উপরন্তু চাকুরীজীবীদের কর্মস্থলের নানাবিধ সমস্যা মাকে মানসিকভাবে চাপগ্রস্থ করতে পারে।
৬. প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঝড়-ঝাপটা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি বিষয়গুলো গর্ভবতী নারীর মনের উপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ঝুঁকি পূর্ণ কারা?
১. নিজের অথবা পরিবারের নিকটতম সদস্যদের মধ্যে কারো মানসিক রোগের ইতিহাস থাকলে।
২. মা মানসিকভাবে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কিন্তু স্বামী বা পরিবারের চাপে সন্তান নিতে হলে।
৩. বাল্য-বিবাহের শিকার নারীর মানসিক রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। কারণ কম বয়সী নারীর শরীর ও মন কোনটাই সন্তানধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিপক্কতা অর্জন করে না।
৪. গর্ভকালীন সময়ে দাম্পত্য কলহের কারণে নারীর মানসিক অবস্থার অবনতি হতে পারে।
৫. গর্ভকালীন বা প্রসব-কালীন সময়ের কষ্টকর অনুভূতি যেমন গর্ভাবস্থায় খিচুনি (একলাম্পশিয়া), প্রসবকালীন তীব্র যন্ত্রণা, নবজাতকের মৃত্যু অথবা প্রসবসংক্রান্ত কোন জটিলতা যেমন প্রসব-জনিত ফিস্টুলা ইত্যাদি নারীকে মানসিকভাবে চাপগ্রস্থ করতে পারে।
৬. নবজাতক সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে, এই নিয়ে পারিবারিক অসন্তুষ্টি এবং মাকে দোষারোপ করা। যেমন: ছেলে হলো না কেন, মেয়ে হলো কেন ইত্যাদি কারণে নারীর মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে।
কখন এবং কি ধরনের মানসিক সমস্যা হতে পারে?
একজন মা গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসব-পরবর্তী যে কোনও সময়ে নানা ধরনের মানসিক উপসর্গে ভুগতে পারেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মেজাজের ওঠা-নামা যেমন খিটখিটে মেজাজ, অকারণে মন খারাপ, অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হওয়া ইত্যাদি। এ সময়ে অনেকে অতিরিক্ত চিৎকার চেঁচামেচি, তুচ্ছ কারণে কান্নাকাটি, অনেক বেশি অভিযোগ ইত্যাদি করে থাকেন। এ ছাড়াও অনেকের ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা (কম ঘুম/বেশি ঘুম), খাওয়ার সমস্যা (কম খাওয়া/ অতিরিক্ত খাওয়া) প্রভৃতি দেখা যায়। তার মধ্যে উদ্যমহীনতা, অমনোযোগিতার প্রভাব দেখা যায়। কেউ কেউ বন্ধু,পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চান, একা একা থাকতে পছন্দ করেন।
প্রসব পরবর্তী তিন মাস বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
গর্ভকালে শরীরে বিভিন্ন হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রসব পরবর্তী সময়ে এই হরমোনগুলো কমতে শুরু করে। হরমোনের এই তারতম্যের ফলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে নানা ধরনের পরিবর্তন হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –
ব্লু বা বেবি ব্লু অবস্থা: প্রায় ৫০ থেকে ৭০ ভাগ মা এ সমস্যায় ভোগেন। প্রসবের পরপরই অর্থাৎ ৩/৪ দিন পর বেবি ব্লু হয়ে থাকে। এর লক্ষণসমূহ হলো- খিটখিটে মেজাজ, ধৈর্যচ্যুতি, অল্পতেই রেগে যাওয়া, কখনো খুশী/কখনো কান্না, কম ঘুম ইত্যাদি। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সাধারণত কোনও ওষুধের দরকার হয় না। সুষম খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম এবং সর্বোপরি মাকে মানসিকভাবে সমর্থন দিয়েই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে।
বিষণ্নতা: এ অবস্থা শুরু হয় সাধারণত প্রসব পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। কখনো কখনো সন্তান জন্মদানের ৬ – ১২ মাসের মধ্যেও হতে পারে। এ ছাড়া গর্ভকালীন সময়েও মা বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন। ১০ থেকে ২০ ভাগ মা প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতায় ভোগেন। এ ছাড়াও হতাশা, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা ইত্যাদিতে মা ভুগতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে মায়ের মধ্যে আত্মহনন, এমনকি সন্তানকে হত্যা করার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এই রোগীদেরকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
সাইকোসিস বা মনোব্যাধি: প্রতি হাজারে ১ থেকে ২ জন মা এ রোগে আক্রান্ত হন। সাধারণত প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে এ রোগ দেখা দেয়। এই সময় রোগী আবোল-তাবোল কথা বলেন, হঠাৎ কোথাও চলে যেতে চান। অনেক সময় তিনি অলীক কিছু দেখতে পান। তাঁর মনে নবজাতক সম্পর্কে ভুল বিশ্বাস জন্মে। তিনি গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান। যেমন – এই সন্তান তাঁর বা পরিবারের জন্য ক্ষতিকারক। সুতরাং একে মেরে ফেলা উচিত, তাহলেই সবার জন্য মঙ্গল হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরনাপন্ন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসা পেলে সুস্থ হতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। তবে কখনো কখনো দীর্ঘদিন এই অসুস্থতা চলতে পারে। এসব রোগীর পাশে সারাক্ষণ একজন নিকটাত্মীয় থাকা দরকার – যাতে মা নিজের বা শিশুর কোন ক্ষতি করতে না পারে।
গর্ভস্থ শিশুর জন্য ঝুঁকি
১. মায়ের খাবার গ্রহণে অনীহা, অনিদ্রার ফলে গর্ভস্থ শিশুর পুষ্টি ও বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এতে কম ওজনের শিশু জন্ম নিতে পারে।
২. অকালে প্রসব হতে পারে।
৩. গবেষণায় দেখা যায়, মায়ের মানসিক সমস্যা থাকলে তা সন্তানের মানসিক বিকাশেও প্রভাব ফেলতে পারে।
করণীয়
আমাদের দেশে নারীরা সবসময়ে অবহেলিত। বিদেশে ‘সন্তান ধারণের পূর্ব-প্রস্তুতি’ (Preconptional councelling) বলে একটা বিষয় আছে। অর্থাৎ গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময় থেকেই একজন নারী চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করেন। এর সঙ্গে হবু মা,তাঁর পুরুষ সঙ্গী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গর্ভধারণ সম্পর্কে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো–
১.গর্ভধারণের পর নিয়মিত গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ সময়ে মায়ের পুষ্টি, পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি হবু মাকে মানসিকভাবে চাপমুক্ত রাখতে হবে।
২. প্রসব-পরবর্তী সময়ে মা তার নবজাতককে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। এতে তার পুষ্টি, ঘুম সব কিছুই ব্যাহত হয়। এ ছাড়াও বেশির ভাগ মা-ই বেবি ব্লু তে ভোগেন। তিনি মনে করেন তাঁর শিশুটির ঠিক মতো যত্ন হচ্ছে না। এ সময়ে স্বামীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে।
৩. প্রসবকালীন সময়টা অশুচি বা অপবিত্র কিছু নয়। মা এবং শিশুর বসবাসের জায়গাটি হতে হবে আলো-বাতাস সমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর। নারীদেরকে কুসংস্কারমুক্ত জীবনযাপনে উৎসাহিত করতে হবে।
৪. শুধু শারীরিক নয়, মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য-কর্মীদের মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান আবশ্যক। সর্বোপরি জনগণকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
৫. গর্ভবতী নারীর সার্বিক সুস্থতার জন্য ব্যক্তি,পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।
মায়ের সার্বিক শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার উপর নির্ভর করে তার গর্ভস্থ শিশুর ভবিষ্যৎ। মায়ের মন ভালো রাখতে হলে ঘরে-বাইরে সর্বত্র নিরুদ্বেগ, নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সুস্থ মা মানে সুস্থ শিশু এবং ভবিষ্যতের সুস্থ বাংলাদেশ।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (স্ত্রী রোগ ও প্রসূতি বিদ্যা, কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।