আবদুর রশিদ : বাংলা ভাষা শুধু আমাদের মাতৃভাষাই নয়, আরবির পর সবচেয়ে বেশি মুসলমান কথা বলে এ ভাষায়। অথচ পাকিস্তানি শাসকরা পাকিস্তানের মাত্র ৫ ভাগ মানুষের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি ছাত্রসমাজ। দিয়েছিল বুকের রক্ত।
ভাষা মানুষের জন্য আল্লাহ-প্রদত্ত এক উপহার। আদি মানব হজরত আদম (আ.)-কে আল্লাহ জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। জ্ঞান শিক্ষার মাধ্যম হলো ভাষা। মানুষ যেমন আল্লাহর সৃষ্টি তেমন ভাষার স্রষ্টাও আল্লাহ।
ইরশাদ হচ্ছে, ‘রহমান, তিনি কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে। সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী রয়েছে।’ (সুরা আর রহমান, আয়াত ১-৫।)
কোরআনের বাণীতে স্পষ্ট বোঝা যায়, মানুষ সৃষ্টির পর মনের ভাব প্রকাশের পদ্ধতি ও তার মাধ্যম ভাষা আল্লাহই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। ভাষা মহান সৃষ্টিকর্তার দান। অন্যান্য নিয়ামতের মতো ভাষাও আল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত। দুনিয়ার কোনো ভাষাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। কারণ আল্লাহ সব ভাষার স্রষ্টা। আল্লাহ সব ভাষাই জানেন এবং যে ভাষায় তাঁকে ডাকা হোক না কেন তিনি বোঝেন। দুনিয়ায় যে শত শত ভাষা রয়েছে তা আল্লাহর বিশেষ কুদরত।
বলা হচ্ছে, ‘তাঁর (আল্লাহ) নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশগুলো ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বিভিন্নতা। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াত ২২)
আল্লাহ মানুষের ভাষাকে তাঁর সৃষ্টির অন্যতম নিদর্শন হিসেবে গণ্য করলেও সে ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট ভাষার কথা বলেননি। রসুলুল্লাহ (সা.) আরবে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন আরবিভাষী। তিনি বলেছেন, ‘তিনটি কারণে আমি আরবি ভাষাকে ভালোবাসি। কেননা আমি আরবি ভাষাভাষী, কোরআনের ভাষা আরবি এবং জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি।’
তাঁর মাতৃভাষা আরবি হওয়ায় তিনি সে ভাষাকে ভালোবাসার গরজ অনুভব করেছেন। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসার তাগিদ সৃষ্টি করেছেন। সহজাত কারণে প্রতিটি মানুষের কাছে তার মাতৃভাষা অতিশয় প্রিয়। আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতিটি বান্দা যেমন সমান, ভাষার মর্যাদার ক্ষেত্রেও তেমন কোনো প্রভেদ থাকতে পারে না।
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শিশু মাতৃস্নেহে বেড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে মায়ের ভাষা শিখে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে। মা, মাতৃভাষা মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে যেহেতু জড়িত সেহেতু একে অস্বীকার করা নিজের অস্তিত্ব অস্বীকারেরই নামান্তর। আল্লাহ যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নবী-রসুল পাঠিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষায় আল্লাহর দীন প্রচার করেছেন এবং আল্লাহ নবী-রসুলদের মাতৃভাষায় কিতাব অবতীর্ণ করেছেন।
আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রসুলকে তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। এরপর আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন যাকে চান এবং পথ দেখান যাকে চান, তিনি মহাসম্মানিত, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত ৪)।
হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর নাজিল হয়েছিল আসমানি কিতাব তাওরাত হিব্রু ভাষায়। হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর নাজিলকৃত জবুর ছিল ইউনানি ভাষায়। হজরত ইসা (আ.)-এর ওপর নাজিলকৃত ইনজিলের ভাষা ছিল সুরিয়ানি। আমরা আখেরি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত। তাঁর ওপর নাজিলকৃত কোরআনের ভাষা হিসেবে আরবি ভাষা দুনিয়ার সব মুসলমানের কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
আল্লাহর ইবাদতের জন্য মুসলমান হিসেবে আমরা আরবি ভাষার মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য। একইভাবে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনে মাতৃভাষা বাংলার বাইরেও যে কোনো ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। দুনিয়ার সব ভাষা যেহেতু আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর মহান নিয়ামত সেহেতু কোনো ভাষাকে অবজ্ঞা করার অবকাশ নেই। আল্লাহ আমাদের মাতৃভাষার চর্চাসহ বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা ও চর্চার তৌফিক দান করুন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।