রিফাক আহমেদ : সৌরশক্তি, বায়ুশক্তির পর সমুদ্রকে বশে আনার চেষ্টা বহুকাল ধরে চলছে। অফুরন্ত ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎস হিসেবেও সমুদ্রের ঢেউ কাজে লাগানোর নানা উদ্যোগ দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে এখনো সাফল্য না এলেও বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়ছেন না। উত্তাল ও লবণাক্ত মহাসাগরের জ্বালানি ব্যবহারের পথে অনেক বাধা রয়েছে।
নানা পূর্বাভাস সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে সাফল্য এখনো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। তা সত্ত্বেও অনেক ইঞ্জিনিয়ার মনে করেন, সামুদ্রিক জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সাফল্য পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
সমুদ্র প্রায় ৩৬ কোটি বর্গকিলোমিটার, অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ দখল করে রয়েছে। সেখানে প্রকৃতির জোরালো শক্তি, বাতাসের ধাক্কায় তৈরি বিশাল ঢেউ, চাঁদের প্রভাবে জোয়ার-ভাটার খেলা চলে।
ফলে মহাসাগরগুলো পরিবেশবান্ধব জ্বালানির বিশাল উৎস হয়ে উঠতে পারে।
মধ্যযুগেই মানুষ প্রথমবার ঢেউয়ের শক্তি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল। জোয়ার ও ভাটার উচ্চতার তারতম্যের ফায়দা তুলতে ঘানির চাকা বসানো হয়েছিল। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সেই আইডিয়া আবার কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল।
ফ্রান্সের ব্রিটানি অঞ্চলে জোয়ার-ভাটার শক্তি কাজে লাগাতে ইঞ্জিনিয়াররা সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। পানির উচ্চতার পার্থক্য কাজে লাগাতে বাঁধের প্রাচীরে টারবাইন বসানো হয়েছিল; কিন্তু ইঞ্জিনিয়াররা একটি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সমুদ্রতীরে খুব কম এমন খাঁড়ি রয়েছে, যা এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত। তাঁরা অবশ্য হাল ছাড়েননি। অন্যভাবে সমুদ্রের শক্তি কাজে লাগানোর চেষ্টা শুরু করলেন তাঁরা।
যেমন—ঢেউয়ের সাহায্য নিয়ে। দেখা গেল, বাতাসের ধাক্কায় ঢেউয়ের শক্তি দুই মেরুর দিকে অনেক বেশি শক্তিশালী।
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে স্কটল্যান্ডে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম তৈরি করেন, যেগুলোর সাহায্যে ঢেউয়ের ওঠানামার গতি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। ফলে বিপুল উৎসাহ দেখা দিল। বিকল্প এই জ্বালানি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে বলে আশা জেগে উঠেছিল; কিন্তু সেই যুগের আইডিয়া বাস্তবে রূপান্তর করা সম্ভব হয়নি। চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকে নতুন এক প্রচেষ্টা দেখা গেল, যার নাম ‘সামুদ্রিক সাপ’। এর আওতায় ধাতুর নলের মধ্যে ঢেউয়ের সঞ্চালনকে বিদ্যুতে রূপান্তর করে। কিন্তু এই প্রচেষ্টাও পরীক্ষামূলক স্তরেই থেকে গিয়েছিল। বর্তমানে জার্মানির ইঞ্জিনিয়াররা অন্য একটি প্রণালি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। ‘নেমোস’ নামের প্রকল্পের আওতায় ঢেউগুলো ভাসমান বস্তুকে পানির উপরিভাগে ঠেলে দেয়। সেটি বস্তু তারের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশে গাঁথা থাকে। একটি জেনারেটর সেই ট্র্যাকশনকে বিদ্যুতে রূপান্তর করে। এ নিয়ে পরীক্ষা এখনো চলছে।
এখনো পর্যন্ত কোনো মডেলই সাফল্য পায়নি। অনেক প্রোটোটাইপ বাতিল হয়ে গেছে। প্রযুক্তিগত বাধা এর অন্যতম কারণ। ঢেউয়ের উচ্চতায় বারবার পরিবর্তন ঘটে। কখনো নিচু, কখনো অনেক উঁচু ঢেউ জেগে ওঠে। ফলে ঢেউয়ের শক্তিরও পরিবর্তন ঘটে। সেই তারতম্য সামলাতে হলে যন্ত্রগুলোর গঠন স্থিতিশীল হতে হবে। এ ছাড়া নিচু ঢেউ দেখা দিলে অত্যন্ত কম জ্বালানি উৎপাদিত হয়। ঢেউয়ের শক্তি কাজে লাগাতে নানা রকম প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। সে কারণে ‘প্লেট আই’ নামের নতুন প্রচেষ্টার আওতায় টারবাইনগুলো র্যাফট বা ভেলার ওপর বসানো হয়েছে। ফলে সহজেই সেগুলো মেরামত করা সম্ভব।
সাগরের পানি থেকেই বিদ্যুৎ তৈরি করতে চলেছে ভারতের বিখ্যাত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাজ আইআইটি। এরই মধ্যে এই পদ্ধতিতে একাধিকবার পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। বিখ্যাত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, আগামী তিন বছরের মধ্যে সাগরের পানি থেকে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করা যাবে। তামিলনাড়ুর তুতিকোরিন সৈকত থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রটি বসানো হয়েছে।
জানা গেছে, আইআইটি মাদ্রাজে সমুদ্রের ঢেউকে কাজে লাগিয়ে সিন্ধুজা-আই নামের একটি যন্ত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি করা হবে। নৌকার মতো দেখতে এই যন্ত্রেও হাল আর বইঠা আছে। তার মধ্যে রাখা হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্র। ঢেউ এলে এই নৌকাও ওঠানামা করবে। এই পরিস্থিতিতে পানির যে গতি আর চাপ তৈরি হবে, সেই চাপ কাজে লাগাবে নৌকার ভেতরের বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রটি। এভাবে বিদ্যুৎ তৈরি করে তা কাজে লাগানো যাবে। প্রায় সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত রয়েছে ভারতে। সেখান থেকে প্রতিবছর ৫৪ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে।
অবশেষে আমাদের দেশেও সাগরের ঢেউ কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর জন্য অ্যাকুস্টিক ডপলার কারেন্ট প্রফাইলার (এডিসিপি) যন্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। গত ৫ জুলাই জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এক প্রশ্নের লিখিত উত্তরে প্রধানমন্ত্রী এসব তথ্য জানান। টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামসংলগ্ন সমুদ্র এলাকার স্রোত ও ঢেউ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রমের ম্যাপিং হচ্ছে।
লেখক : প্রকৌশলী
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।