আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সম্প্রতি অ্যান্টার্কটিকায় হাজার হাজার বাচ্চা পেঙ্গুইনের এক করুণ গণমৃত্যুর স্বাক্ষী হল বিশ্ব। ধারণা করা হচ্ছে, ওই ঘটনায় একসাথে ১০ হাজার এমপেরর পেঙ্গুইনের মৃত্যু ঘটেছে। খবর বিবিসি’র।
এই বাচ্চা পেঙ্গুইনদের পালক সাঁতারের জন্য উপযোগী হওয়ার আগেই তাদের পায়ের নিচে থাকা সমুদ্রের বরফ গলে এবং ভেঙে যায়। আর তা থেকেই বরফ পানিতে ডুবে বা ঠান্ডায় জমে বাচ্চাগুলোর মৃত্যু ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
পেঙ্গুইনের মধ্যে উচ্চতা এবং ওজনে সবচাইতে বড় জাতের প্রাণীটিকে এমপেরর পেঙ্গুইন বলা হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে ২০২২ সালের শেষ দিকে, অ্যান্টার্কটিকার দক্ষিণে বেলিংহাউজেন সাগরের কাছে। ঘটনাটি ধরা পড়েছে স্যাটেলাইটে।
ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের (বিএএস) বিজ্ঞানী ড. পিটার ফ্রেটওয়েল বলেন, এমন বিলুপ্তির ঘটনা সামনে আরো ঘটবে।
যেভাবে ঘটলো এই ঘটনা
ড. ফ্রেটওয়েল এবং তার সহকর্মীরা কমিউনিকেশন্স আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল জার্নালে হাজারো পেঙ্গুইনের মৃত্যুর এই করুণ ঘটনা তুলে ধরেন।
বিজ্ঞানীরা বেলিংসহাউজেন সাগরে পাঁচটি পেঙ্গুইন কলোনি পর্যবেক্ষণ করেন। এগুলো হচ্ছে – রথসচাইল্ড আইল্যান্ড, ভার্দি ইনলেট, স্মাইলি আইল্যান্ড, ব্রায়ান পেনিনসুলা ও ফ্রিগনার পয়েন্ট।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সেন্টিনেল টু স্যাটেলাইট ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা পেঙ্গুইনদের মলমূত্র ত্যাগ থেকে শুরু করে তাদের সমস্ত কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হন।
সাদা বরফের উপর ফেলে যাওয়া তাদের বাদামী রংয়ের বিষ্ঠা মহাকাশ থেকেও সহজেই চোখে পড়ে।
প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা সমুদ্রে জমা এই বরফে হাজির হয় মার্চ মাসের দিকে, যখন দক্ষিণ গোলার্ধে শীত আসতে শুরু করে।
এখানে তারা সঙ্গী খুঁজে নেয়, সঙ্গম করে, ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফুটায়। এরপর কয়েক মাস ধরে তাদের খাইয়ে দাইয়ে প্রস্তুত করে পৃথিবীতে নিজের মতো পথ খুঁজে নিতে।
নতুন পেঙ্গুইনদের সমুদ্রে নামার সময় সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে।
কিন্তু গবেষক দল লক্ষ্য করে এই হাজার হাজার বাচ্চা পেঙ্গুইনের পালক সাঁতারের জন্য প্রস্তুত হবার আগেই, এমপেরর পেঙ্গুইন যেখানে আস্তানা গেড়েছে সমুদ্রের উপর থাকা সেই বরফে ফাটল ধরে যায় নভেম্বর মাসেই।
ফলে চারটি কলোনিতেই এই প্রজনন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। শুধুমাত্র একেবারে উত্তরে থাকা রথসচাইল্ড আইল্যান্ডে থাকা পেঙ্গুইনরা কিছুটা সফল হয় ।
বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, যেহেতু পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে. তার ফলে এই শতকের শেষ নাগাদ পৃথিবী থেকে এমপেরর পেঙ্গুইনের ৯০ শতাংশেরও বেশি কলোনি বা আবাস হারিয়ে যাবে।
“পেঙ্গুইনরা তাদের প্রজননের জন্য সমুদ্রে জমাট বাঁধা বরফের উপর নির্ভরশীল। তাদের সন্তানদের বড় করার জন্য এটাই তাদের টেকসই আবাস। কিন্তু যদি সেই বরফ যথেষ্ট শক্ত না হয়, অথবা দ্রুত ভেঙে যায় তাহলে এই পাখিদের বিপদ,” – বিবিসিকে বলেন ড. ফ্রেটওয়েল।
“একমাত্র আশা হচ্ছে, আমরা যদি এই পৃথিবীর উষ্ণতার জন্য দায়ী কার্বন নি:সরণ কমাতে পারি। আর যদি সেটা না হয় তাহলে হয়তো আমাদের কারণে এই চমৎকার পাখির অস্তিত্বই বিলোপ হয়ে যাবে।”
এর আগে দেখা যায় ২০১৬ সাল থেকেই অ্যান্টার্কটিকায় গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের বরফ কমে যাচ্ছে। অ্যান্টার্কটিকা জুড়েই পানিতে জমাট বাঁধা মোট বরফের পরিমাণও প্রতিনিয়ত কমে যাওয়ার নতুন রেকর্ড গড়ছে।
গত দুই বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ এর গ্রীষ্মকালে সমুদ্রে বরফের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন, এ সময় বেলিংসহাউজেন সাগর প্রায় পুরোপুরি বরফের আবরণমুক্ত হয়ে পড়ে।
এর সাথে আরও বিপদের কারণ হল বিগত কয়েক মাসে বরফ জমাট বাঁধছে খুব ধীরগতিতে। যার মানে আরও অন্তত এক বছর পেঙ্গুইনরা প্রজনন করতে পারবে না।
শীতের সময় বরফ জমাট বাঁধার পরিমাণটা সর্বোচ্চ পৌঁছায় সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু এবার সেপ্টেম্বরে সাধারণত বরফ যতোটা জমাট থাকে তার চেয়ে অনেক কম থাকবে।
ড. ফ্রেটওয়েল এবং তার সহকর্মীরা বলেন এমপেরর পেঙ্গুইনরা জলবায়ু পরিবর্তনের এ প্রভাব টের পাচ্ছিল। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পেঙ্গুইনদের পরিচিত ৬০টি কলোনির অন্তত এক তৃতীয়াংশ কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোথাও হয়তো বরফ পরে জমছে বা আগেই গলে যাচ্ছে।
এই গ্রহের একেবারে অন্যপ্রান্তে আর্কটিক অঞ্চলে, সমুদ্রের বরফ গত কয়েক দশক ধরেই ক্রমান্বয়ে কমছে।
সে তুলনায় অ্যান্টার্কটিক অনেকটা শক্তিশালী অবস্থানেই ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত, এর সীমা বরং বাড়ছিল।
পেঙ্গুইনদের প্রজনন সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য ৮ থেকে ৯ মাস বরফ জমাট থাকা জরুরী
ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের ড. ক্যারোলিন হোমস একজন সমুদ্র-বরফ বিশেষজ্ঞ।
তিনি এই সাম্প্রতিক পতনের জন্য এই মহাদেশজুড়ে সমুদ্রের পানি অস্বাভাবিক উষ্ণ হয়ে ওঠা এবং এক বিশেষ ধরণের বাতাসকে দায়ী করছেন, বেলিংসহাউজেনে এ বাতাস বরফকে উপকূলের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ফলে তা ছড়িয়ে পড়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
এই সময়টা খুবই গূরুত্বপূর্ণ বলেন ড. ক্যারোলিন।
“আমরা এতদিন ধরে যা পর্যবেক্ষণ করে এসেছি তা থেকে এখন যা দেখছি সেটি পুরোই আলাদা। আমরা পরিবর্তনের শঙ্কা করেছিলাম, কিন্তু সেটা যে এত দ্রুত হবে তা আশা করিনি।”
বিবিসিকে তিনি আরো বলেন, “আর্কটিকের গবেষণায় দেখা গিয়েছে আমরা যদি কোনভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে পারি তাহলে উত্তর মেরুতে সমুদ্রের বরফ রক্ষা করা যাবে।
এখন সেটা অ্যান্টার্কটিকার ক্ষেত্রেও কাজ করবে কি-না তা আমরা নিশ্চিত নই। তবে এটা তো বলাই যায় যে ঠান্ডা যদি যথেষ্ট হয় তাহলে সমুদ্রের বরফ আবারও জমাট বাঁধবে।”
বর্তমানে এমপেরর পেঙ্গুইনকে ‘বিলুপ্তপ্রায়’ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার আইইউসিএন। এই সংস্থাটি বিশ্বজুড়ে হুমকিতে থাকা প্রাণীর তালিকা করে থাকে।
জলবায়ু যেভাবে এ পেঙ্গুইনদের জীবনচক্র হুমকিতে ফেলে দিয়েছে, তাতে তাদের আরো জরুরী ভিত্তিতে ‘ভালনারেবল’ বা বিপন্ন তালিকায় নিয়ে আসা হোক, এমন একটি প্রস্তাব নিয়ে কাজ চলছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।