জুমবাংলা ডেস্ক : ভারত থেকে কম্পিউটার সাইন্সের ওপর পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে একটি কনসালট্যান্সি ফার্মে কাজ শুরু করেন আতাউর রহমান শাহিন। দুই বন্ধু মিলে একটি কনসালট্যান্সি ফার্মও দেন। কাজে দক্ষ হওয়ার মাঝেমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ডাক আসত তার।
২০১৯ সালের ২ মে গুলশান লিংক রোড থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আতাউরকে। তখন তার স্ত্রী তানিয়া ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা—এই অবস্থায় তিনি স্বামীর খোঁজে ঘুরেছেন মন্ত্রী, স্পিকারের বাড়ি বাড়ি। তাকে তো সহযোগিতা করা হয়ইনি বরং দুর্ব্যবহার করা হয়। ৯৪ দিন পর আতাউরকে চোখ বেঁধে ক্ষিলখেত এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
কী হয়েছিল, কেন নিয়ে গিয়েছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে আতাউর বলেন, ২০১৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সার্ভার সেটআপ করে দেন। বন্দি হওয়ার এক সপ্তাহ আগে তাকে আবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফোন করা হয়। সেখান থেকে বলা হয়—ভাই, আমাদের এখানে একটা মেইল আসে, মেইলটা ডিজিএফআইয়ের কাছে চলে যায়। আমরা ট্রেস করতে পারছি না। আমাকে একটু ঐদিনের রিপোর্ট জেনারেট করে দিতে বলে। আমি দুই-তিন পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট করি এবং আমার জিমেইল থেকে ওদের মেইল করি। ওরা সম্ভবত মনে করে ডিজিএফএইকে মেইল আমিই করি।
বন্দি হওয়ার দিন ৭টা সাড়ে ৭টার দিকে আমি কাজ শেষ করে পাঠাও বাইকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম—এমন সময় একটি মাইক্রোবাস এসে আমার সামনে থামে। মাইক্রোবাস থেকে নেমে চার জন আমাকে ধাক্কা মেরে মাইক্রোবাসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। আমার মাথায় একটি টুপি পরিয়ে দেয়। চোখে যাতে না দেখি তার জন্য আরেকটি মাক্স পরায়। আমাকে গাড়ির সিটে শুইয়ে দেয়। এক জন আমার পায়ের ওপর বসে পড়ে। একজন আমার বুকের কাছে রিভলবার ধরে। ওরা কয়জন ছিল আমি জানি না। তবে সবাই মিলে আমাকে জোর করে ধরে রাখে যে আমার ব্যাকপেইনটা বেড়ে যায়।
ওরা আমাকে ঢাকার অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক জায়গাতে নিয়ে আসে। সেখানে একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে আমাকে নিয়ে যায়। আগে থেকেই কেউ অপেক্ষা করছিল। শুরু হয় আমাকে প্রশ্ন করা—২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দিয়ে প্রশ্ন করা শুরু হয়। ওরা জানতে চায়, আমি এই বিষয়ে সরকারবিরোধী কোনো পোস্ট দিয়েছি কি না। তখন আমি বলি—না। আমি ছাত্র না, আমি কেন ওরকম পোস্ট দেব। আমি আমার মোবাইল দিয়ে চেক করতে বলি। ওরা আমার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাসওয়ার্ড নিয়ে খুঁজে কিছু পায় না।
পরে আবার প্রশ্ন করে আমি প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ে যাই কি না। তখন আমি জানাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক কাজ করেছি। এক সপ্তাহ আগের ঘটনাও বলি, তখন ওরা আমার জিমেইলের পাসওয়ার্ডের সঙ্গে আমার অফিসের সব পাসওয়ার্ড নেয়। আমার সেন্ড মেইলে ঐ মেইলটি ছিল এবং আমার ল্যাপটপে ভিপিএন থাকায় ওরা এবার আমাকে রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে, কোন দলের রাজনীতি করি—এমন নানা প্রশ্ন করতে থাকে। আমি ওদের জানাই আমি কোনো রাজনীতি করি না। একজন বলে, ও সব কথা না জানালে ওর গোপন অঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দাও। আর একজন রিভলবার লোড করে ভয় দেখায়। কেউ লাঠি দিয়ে মাটিতে ঠুকঠুক শব্দ করতে থাকে। অনেক জেরা আর আমার জিমেইলসহ সব চেক করার পর ওরা আমাকে আর একটি ঘরে নিয়ে আসে। সেখানে আমার প্যান্ট খুলে একটি লুঙ্গি ও একটি ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জি পরায়।
তিনি যখন জানতে পারেন—এখন রাত একটা বাজে তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি আতাউর। মনে করেন তার গর্ভবতী স্ত্রী, অসুস্থ বাবা-মার কী অবস্থা! তারা তো তার কোনো খোঁজ জানে না। তারা কী করছে? কোথায় খুঁজছে তাকে। আয়নাঘরে একবারও ঠিকভাবে ভাত খেতে পারিনি। নিজের চোখের পানিতে ভাত ভিজে যেত।
আতাউর বলেন, আয়নাঘরে আয়না নেই, আছে বীভত্স কবরের যন্ত্রণা। দৈর্ঘ্যে সাত ফিট আর প্রস্থে চার ফিটের একটি ঘরে কেটেছে তিন মাসের বেশি সময়। বলেন, দরজার দুই পাশে দুইটা ফ্যান ছিল তবে সেটাতে কোনো বাতাস হতো না। এই ফ্যান চালালে বাইরের কী হচ্ছে, বোঝার মতো অবস্থা থাকত না। ঘরের ওপরে লাইট যেটা ছিল, সেটা অনেক ভোল্টেজের। মনে হয় চোখ বন্ধ করলেও আলো চোখে চলে আসে। ঘরের দেওয়ালে ছিল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। পাশের ঘরগুলো প্রায় প্রতি রাতেই শুনতেন আর্তনাদের শব্দ। ঘরটিকে কবরের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। বলেন, কবরে গেলেও দুনিয়ার কারো সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না, এখানেও ঠিক তাই।
আয়নাঘর থেকে ফিরেই হারিয়েছেন চাকরি। নিষেধ ছিল নতুন চাকরিতে যোগদান নিয়েও। ছাড়া পেলেও আয়নাঘরের নির্যাতনের কথা পাঁচ বছরেও স্ত্রীকে কিছুই জানাননি। স্ত্রী তানিয়া আক্তার জানান, স্বামীকে হারানোর পর এক দিনও তিনি বাড়িতে থাকেননি। অনেক খুঁজেছেন তাকে। এক ব্যক্তি ফোনে স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়া কথা বলে ২ লাখ টাকা দাবি করে। দেনদরবারের পর ধার করে ১ লাখ টাকা তাকে দেওয়া হয়। এরপর সরকারের সব পর্যায়ে কথা বললেও কোনো সমাধান হয়নি। ৯৪ দিন পর একটি সিএনজি নিয়ে বাড়ি ফেরেন স্বামী। এরপর কেটেছে পাঁচ বছরের বেশি সময়। পরিবর্তন হয়েছে সরকারের। সাহস মিলেছে মুখ খোলার। এখন বিচার চান আতাউর।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।