অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী : জ্বর কোনো অসুখ নয়। অসুখের উপসর্গ মাত্র। শিশু বয়সে অসুখের প্রধান উপসর্গ জ্বর। জ্বর সর্বদা ক্ষতিকর নয়।
মা-বাবা ও অভিভাবকের জানা উচিত শিশু কোনো অসুখে পড়লে শরীর রোগের বিরুদ্ধে জ্বর উপসর্গের মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ভূমিকা গ্রহণ করে। সে কারণে অল্প মাত্রার জ্বর সাধারণভাবে কোনো ক্ষতি সাধন করে না, বরং উপকারী। সে কারণে এ ধরনের অল্প মাত্রার জ্বর নিবারণে ওষুধ প্রয়োগের প্রয়োজন থাকে না।
শিশুর জ্বর কমানোর প্রধান উদ্দেশ্য শিশুকে স্বস্তি দেওয়া। তাপমাত্রা সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক করে আনা প্রধান লক্ষ্য নয়। তবে শিশুর জ্বর সহনীয় মাত্রার মধ্যে আনা গেলে তা শিশুকে যেমন স্বস্তি দেয়, তেমনি মা-বাবাকেও কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত রাখে।
শিশুর জ্বর লাঘবে যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, তা প্রধানত দুই ধরনের।
ওষুধ ব্যতিরেকে―
ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
শিশুকে আলো-বাতাসপূর্ণ ঘরে রাখতে হবে। ঘরে তাপমাত্রা ২১-২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখা উচিত। শিশুকে যথাসম্ভব কম কাপড়চোপড় পরাতে হবে। তাকে একপ্রস্থের কাপড় পরিধান করাতে হবে। সেই সঙ্গে শিশুর শরীর আলতোভাবে ম্যাসাজ করানো হলে তাপমাত্রা নেমে আসে।
শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ
শিশুর জ্বর হলে শরীরে জ্বলীয় পদার্থের প্রয়োজন বেড়ে যায়। জ্বরের মাত্রা ৩৭.২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি থাকলে প্রতি ডিগ্রি জ্বর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৭ মিলিগ্রাম/প্রতি কেজি হিসেবে পানি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। সে কারণে জ্বরের শিশু রোগীকে বেশি পরিমাণে পানি পান করানো ও তরল খাবার বারবার খাওয়ানো উচিত। বলা হয়, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়ার জন্য ১২ শতাংশ হারে জ্বলীয় পদার্থ শরীরে জোগানো উচিত।
স্পঞ্জিং
শিশুর অতিরিক্ত জ্বর কমিয়ে আনতে ঈষদুষ্ণ পানিতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারা শরীর মুছে দিতে হবে। জ্বরের তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের হবে। ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে এভাবে স্পঞ্জ করা হলে তাপমাত্রা কমে আসে। তবে স্পঞ্জ করানোর ৩০ মিনিট আগে শিশুকে প্যারাসিটামল দেওয়া হলে তা জ্বর কমাতে অধিক কার্যকর বলে প্রমাণিত।
ওষুধের সাহায্যে জ্বর নিবারণ
শিশুর জ্বর লাঘবে প্যারাসিটামল, আইবুপ্রোফেন প্রভৃতি ওষুধ নিরাপদের সঙ্গে ব্যবহার করা যায়। আগে জ্বর লাঘবে অ্যাসপিরিন ওষুধ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু ফ্লু জ্বরে এই ওষুধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিশুর মারাত্মক অসুখ ‘রি-ই সিনড্রোম’ হয় বলে শিশু বয়সের জ্বরে এই ওষুধের ব্যবহার নিষিদ্ধ।
প্যারাসিটামল
প্যারাসিটামল শিশুর জ্বর নিবারণে সর্বাপেক্ষা নিরাপদ ও কার্যকর ওষুধ। ১৫ মিলিগ্রাম/প্রতি কেজি হিসেবে চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর পর এই ওষুধ শিশুকে দেওয়া যায়। তবে দৈনিক পরিমাণ যেন ৬০ মিলিগ্রাম/প্রতি কেজির বেশি না হয়। প্যারাসিটামল খাওয়ানোর দুই ঘণ্টা পর শিশুর জ্বর প্রায় ২-৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত নেমে আসে। তবে বেশি মাত্রার জ্বর, যেমন ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি থাকলে প্যারাসিটামল যেভাবে কাজ করে, অল্প জ্বরে কিন্তু এই ওষুধ ততটা কাজ করে না।
আইবুপ্রোফেন
শিশুর জ্বর কমাতে এই ওষুধও প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করা হয়। ডোজ—১০ মিলিগ্রাম/প্রতি কেজি ওজন হিসেবে। প্রতিবার এই ওষুধ প্রয়োগের পর প্রায় আট ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বর কম থাকে। তুলনায় প্রতি ডোজ প্যারাসিটামল খাওয়ানোর পর শিশুর জ্বর না থাকার সময়কাল হলো চার ঘণ্টার মতো।
মা-বাবার প্রতি
শিশু বয়সে জ্বর প্রায়ই হয়ে থাকে বলে এটি মা-বাবার মনে বেশ দুশ্চিন্তা তৈরি করে। মা-বাবা শিশুর জ্বরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুর জ্বর সাধারণত সর্দি, কাশি, ফ্লু—এসব থেকে তৈরি হয়। অল্পসংখ্যক শিশুর জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হতে দেখা যায়। তবে এই জ্বর-খিঁচুনি মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন কিংবা মৃগী রোগ উৎপন্ন করে না। আগেই বলা হয়েছে, জ্বর রোগের উপসর্গ মাত্র। সুতরাং শিশুর জ্বর হলে জ্বর নিবারণের পাশাপাশি জ্বরের আসল কারণ খুঁজে বের করা উচিত। সে জন্য শিশুর জ্বরে শিশু চিকিৎসকের ব্যবস্থাপনা মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান
শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।