ঢাকার গুলশানে একটি ছোট্ট অফিসে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে উঠেছিল উচ্ছ্বাসের চিৎকার। পাঁচ তরুণ প্রোগ্রামার হাত ধরে নেচেছিল এক অসম্ভবকে জয় করার আনন্দে। তাদের তৈরি সফটওয়্যারটি তখন সিলিকন ভ্যালির এক দৈত্য প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ স্টোরে “বেস্ট নিউ কমার” খেতাব পেয়েছে। তাদের মতোই শত শত তরুণ প্রতিদিন লড়াই করছে নিজেদের আইডিয়াকে ব্যবসায় পরিণত করতে। এই বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ: সাফল্যের গল্প শুধু আর্থিক মুনাফার হিসাব নয়, এদেশের মেধা, অদম্য মনোবল আর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার এক মহাকাব্য।
বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ: সাফল্যের গল্প কীভাবে বদলে দিচ্ছে অর্থনীতির চেহারা
দশ বছর আগেও “স্টার্টআপ” শব্দটি বাংলাদেশে ছিল প্রায় অপরিচিত। আজ? ঢাকার বসুন্ধরায় “বেক্সিমকো ইনোভেশন ল্যাব”, চট্টগ্রামের “বন্দর এক্সেলারেটর” থেকে শুরু করে রাজশাহীর “সিল্ক ভ্যালি টেক হাব”-এ প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ। বিস্ময়কর এই পরিবর্তনের পেছনে কাজ করছে একাধিক শক্তি:
- ডিজিটাল বাংলাদেশের অবকাঠামো: ১৬ কোটি মানুষের ১৭ কোটিরও বেশি মোবাইল সংযোগ আর ১৩.২ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী (বিবিএস ২০২৩) তৈরি করেছে এক বিশাল ডিজিটাল বাজার।
- তরুণ জনশক্তির সুনাম: দেশের ৬৮% জনসংখ্যার বয়স ৩৫ বছরের নিচে। আইটি গ্রাজুয়েটদের সংখ্যা বছরে ৩০,০০০ ছাড়িয়েছে (বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল)।
- ফিনটেক বিপ্লব: bKash, Nagad-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো লেনদেনকে করছে সহজ, স্টার্টআপ ফান্ডিংকে দিয়েছে গতি।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি মানসিকতায়। ২০১০ সালে যখন “পাঠাও” যাত্রা শুরু করেছিল, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন ফুড ডেলিভারি ব্যবসা বাংলাদেশে টিকবে না। আজ পাঠাও শুধু টিকেই নেই, সম্প্রতি ১০০ মিলিয়ন ডলার ফান্ডিং পেয়ে বাংলাদেশের প্রথম “ইউনিকর্ন” স্টার্টআপে পরিণত হয়েছে। তাদের সাফল্য দেখে হাজারো তরুণ স্বপ্ন দেখছে: “আমিও পারব!”
প্রযুক্তি নয়, সমস্যার সমাধানই আসল মন্ত্র। কুমিল্লার মেয়ে তাসনিমা জাহানের গল্প ভাবিয়ে তোলে। গ্রামে বাবার হঠাৎ অসুস্থতার সময় অ্যাম্বুল্যান্স না পেয়ে তিনি তৈরি করলেন “এমার্জি মেডিকেয়ার” অ্যাপ। আজ তার প্ল্যাটফর্মে ৫০০+ এম্বুল্যান্স, ৩০০ ডাক্তার ২৪/৭ সেবা দিচ্ছেন। গত বছর ২ লক্ষ মানুষের জীবন বেঁচেছে এই অ্যাপের মাধ্যমে।
“স্টার্টআপ মানে শুধু প্রফিট শীট নয়, সামাজিক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রতি বছর ১০টি স্টার্টআপকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত গ্র্যান্ট দেই যারা সমাজের বড় সমস্যা সমাধান করছে”
— জুনাইদ আহমেদ পলক, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী (আইসিটি বিভাগ)
সফলতার শীর্ষে যারা: বাংলাদেশি স্টার্টআপের উজ্জ্বল নক্ষত্ররা
১. চালবাজার: কৃষকের বাজিমাত
রংপুরের কৃষক আব্দুর রহিমের চোখে আজ স্বপ্ন। তার উৎপাদিত আলু সরাসরি চট্টগ্রামের রেস্তোরাঁয় বিক্রি হচ্ছে চালবাজার অ্যাপের মাধ্যমে। ফজলে রাব্বি ও তার টিমের তৈরি এই প্ল্যাটফর্ম আজ ৫০,০০০+ কৃষককে ১৫,০০০+ রেস্তোরাঁ ও খুচরা বিক্রেতার সাথে যুক্ত করেছে। গত বছর তাদের লেনদেন ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
২. শিখন: এডটেকের রূপকথা
ঢাকার বস্তিতে বসে মিমি প্রতিদিন শিখন অ্যাপে ইংরেজি শেখে। এই প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি সাদমান সাকিব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে শেখার অভিজ্ঞতা দেওয়া এই অ্যাপ এখন ব্যবহার করছে ৫ লক্ষ+ শিক্ষার্থী। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে পেয়েছেন ৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ।
৩. গ্রিন পাওয়ার: সবুজ বিপ্লবের অগ্রদূত
খুলনার ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলামের স্বপ্ন ছিল নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কিছু করা। তার স্টার্টআপটি এখন সোলার প্যানেল থেকে শুরু করে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের সাশ্রয়ী সমাধান দিচ্ছে গ্রামীণ এলাকায়। তাদের ইনোভেশন “মিনি গ্রিড সিস্টেম” ৩০০+ প্রত্যন্ত গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে।
৪. ফ্যাশনটেক জায়ান্ট “আরিয়ানা”
লোকাল ফেব্রিককে গ্লোবাল ব্র্যান্ডে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু করা এই স্টার্টআপ আজ নিউইয়র্ক, লন্ডনের বুটিকগুলোতে বাংলাদেশি জামদানি, মসলিনের ডিজাইন পাঠাচ্ছে। প্রতিষ্ঠাতা সামিয়া রহমানের কথায়: “আমাদের টেকনোলজি ট্রেডিশনকে নতুন প্রজন্মের সাথে কানেক্ট করছে। লেদার ট্রিমিংয়ে তুঁতের রেশম ব্যবহার করে আমরা কার্বন ফুটপ্রিন্ট ৭০% কমিয়েছি।”
চ্যালেঞ্জের যুদ্ধ: বাংলাদেশি স্টার্টআপারদের মোকাবেলা করতে হয় যেসব বাধা
ফান্ডিং সংকট শুরু থেকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রারম্ভিক পর্যায়ের স্টার্টআপগুলোর মাত্র ১৫% প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ পায়। রাজধানীর বাইরের উদ্যোক্তাদের জন্য অবস্থা আরও শোচনীয়।
নীতিগত জটিলতাও বড় বাধা। স্টার্টআপ নিবন্ধন, ট্যাক্স কাঠামো, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস-এর জটিল প্রক্রিয়া অনেক প্রতিভাবান উদ্যোক্তাকে হতাশ করে। আইন বিশেষজ্ঞ ড. তানজিমা হোসেনের মতে: “স্টার্টআপ আইন ২০১৮ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, কিন্তু এর প্রয়োগে এখনও ফাঁক আছে। উদ্যোক্তাদের ২২টি আলাদা অফিসে ছুটতে হয় শুধু লাইসেন্সের জন্য!”
ব্রেইন ড্রেন আরেকটি উদ্বেগের কারণ। প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০ টেক ট্যালেন্ট উচ্চ বেতনে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রিফাত আহমেদের কথায়: “সিলিকন ভ্যালিতে আমার বেতন এখানকার ৮ গুণ। দেশে কাজ করতে চাই, কিন্তু ইকোসিস্টেম সাপোর্ট করছে না।”
সরকারি উদ্যোগ: স্টার্টআপ বাংলাদেশের জন্য যা করা হচ্ছে
সরকারের “স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড” (এসবিএল) এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছে। তাদের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ:
- সিড ফান্ডিং: প্রোটোটাইপ পর্যায়ের স্টার্টআপকে ২৫-৫০ লাখ টাকা অনুদান
- ইনকিউবেশন সেন্টার: ঢাকা, সিলেট, খুলনায় ৫টি হাইটেক পার্কে বিনামূল্যে অফিস স্পেস
- মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম: অভিজাত উদ্যোক্তা ও বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞদের গাইডেন্স
- আইসিটি ডিভিশনের হ্যাকাথন: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ
“২০২৪ সালের মধ্যে ৫,০০০+ স্টার্টআপ তৈরি করতে চাই, যারা ১০ লক্ষ তরুণের কর্মসংস্থান করবে”
— জুনাইদ আহমেদ পলক, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী
ভবিষ্যতের দিগন্ত: কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম
গ্রিন টেক ও ক্লাইমেট টেক হবে আগামীর গেম চেঞ্জার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে জলবায়ু অভিযোজন প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ হতে পারে বিশ্বনেতা। ইতিমধ্যে “ক্লাইমেট ইনোভেশন হাব” চালু করেছে সরকার।
হেলথটেকে বিপ্লব আসতে চলেছে। করোনা মহামারি ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব বাড়িয়েছে। “টেলিমেড” অ্যাপগুলো এখন প্রতিমাসে ২ লক্ষ কন্সাল্টেশন দেয়। ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্টে “ডায়াবেটো” অ্যাপের ব্যবহারকারী সংখ্যা ১ লক্ষ ছাড়িয়েছে।
গ্লোবাল এক্সপানশন হবে মূল থিম। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি স্টার্টআপের প্রসার বাড়ছে। ফিনটেক কোম্পানি “ওয়ালেটফাই” সম্প্রতি কাতারে সার্ভিস চালু করেছে।
বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ: সাফল্যের গল্প শুধু অর্থনৈতিক সূচকের কথা বলে না, বলে অসম্ভবকে জয় করার এক জাতির গাথা। প্রতিটি অজানা পথের পথিক, প্রতিটি ব্যর্থতাকে পাথর বানিয়ে সাফল্যের পিরামিড গড়ার এই যাত্রায় আমরা সবাই সাক্ষী। আপনার মোবাইল ফোনে যে অ্যাপটি এখনও তৈরি হয়নি, আপনার গ্রামের সেই সমাধান যা এখনও কেউ বানায়নি—সেই ভবিষ্যতের উদ্ভাবক হয়তো আজ এই লেখাটিই পড়ছেন। সময় এসেছে হাতের মুঠোয় থাকা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বপ্নের নকশা শুরু করার। বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ: সাফল্যের গল্পের পরবর্তী অধ্যায়টি কি আপনিই লিখবেন?
জেনে রাখুন
বাংলাদেশের স্টার্টআপ সাফল্যের গল্প সম্পর্কে কী কী সরকারি সহায়তা পাওয়া যায়?
সরকারের “স্টার্টআপ বাংলাদেশ” প্রকল্পের মাধ্যমে প্রোটোটাইপ পর্যায়ে ২৫-৫০ লাখ টাকা অনুদান, বিনামূল্যে ইনকিউবেশন স্পেস, আইটি প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপ পাওয়া যায়। এছাড়া আইসিটি বিভাগের “আইডিয়া প্রকল্প” প্রতিযোগিতায় বিজয়ীরা ১০-৩০ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে স্টার্টআপ নিবন্ধন প্রক্রিয়া কেমন?
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ওয়েবসাইটে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স, টিন সার্টিফিকেট, কোম্পানি ঠিকানা ও ব্যবসায়িক মডেলের বিবরণী জমা দিতে হয়। সাধারণত ১৫-৩০ কর্মদিবসের মধ্যে নিবন্ধন সম্পন্ন হয়।
কোন কোন সেক্টরে বাংলাদেশি স্টার্টআপ সবচেয়ে বেশি সফল?
ফিনটেক, এডটেক, হেলথটেক, লজিস্টিকস ও ই-কমার্স সেক্টরে বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলো উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এগ্রিটেক, ক্লিন টেক ও ফ্যাশনটেকেও বাড়তি বিনিয়োগ আসছে।
বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশি স্টার্টআপে বিনিয়োগে কেন আগ্রহী হচ্ছেন?
বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রসারের গতি, বিশাল তরুণ ভোক্তাবাজার ও সরকারের ইতিবাচক নীতির কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ২০২২-২৩ সালে বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলো রেকর্ড ১৫০+ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ পেয়েছে।
বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলো সামাজিক সমস্যা সমাধানে কী ভূমিকা রাখছে?
অনেক স্টার্টআপই সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে কাজ করছে। যেমন—গ্রামীণ নারীদের আয়মূলক কর্মসংস্থান তৈরি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী সমাধান নিয়ে আসছে।
বাংলাদেশি স্টার্টআপের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে কী কী করতে হবে?
স্থানীয় সমস্যার গ্লোবাল সলিউশন তৈরি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানো, আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে গবেষণা এবং ক্রস-কালচারাল মার্কেটিং কৌশল রপ্ত করতে হবে। এশিয়ান টাইগার হিসেবে বাংলাদেশের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে ব্র্যান্ডিং করাও গুরুত্বপূর্ণ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।