জুমবাংলা ডেস্ক : খড়ম, কাঠের পাদুকা বা কাষ্ঠ পাদুকা বর্তমান প্রজন্মের কাছে একেবারেই অচেনা। তবে আশির দশক ও তার আগে এই খড়মের প্রচলন ছিল বিস্তর।
খড়ম পরে হাঁটার ভিন্ন ধরনের শব্দ গৃহস্থদের বুঝিয়ে দিতো বাড়িতে কেউ আসছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঠের তৈরি সেই পাদুকা এখন শুধুই স্মৃতি! আর শখের বসে কিংবা অভ্যেসের দায়ে এখনও যদি কেউ খড়ম পরে হাঁটেন তাহলে তাকে নেহাত ভিন্ন জগতের মানুষ হিসেবেই দেখেন এই প্রজন্ম।
৪০ বছর (চার দশক) ধরে খড়ম পায়ে দিয়ে হেঁটে চলেছেন বরিশালের আগৈলঝাড়ার রাজিহার ইউনিয়নের পশ্চিম রাংতা গ্রামের বাউল আবদুল মান্নান। খড়ম পায়ে দিয়ে আর শরীরে সাদা রঙের সফেদ কাপড় জড়িয়ে নিয়ে কখনও ভাণ্ডারি, কখনও বাউল বা লালনগীতি গাইতে গাইতে পথ চলেন তিনি। আর এ কারণে যিনি নিজ এলাকায় বাউল মান্নান, ভাণ্ডারি মান্নান নামেই বেশি পরিচিত।
দীর্ঘদিন ধরে এই খড়ম পায়ে দেওয়ায় তার শরীরে নেই রোগ-বালাই। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খড়ম পায়ে ছুটে চলা মানুষটি নীরোগ সহজ সরল ও সাদা মনের মানুষ।
জানা গেছে, আমাদের দেশে খড়মের ব্যবহার অনেক প্রাচীন। ১৩০৩ সালে সুফি দরবেশ ও পীর হজরত শাহজালাল (রহ:) সুদূর তুরস্ক থেকে সিলেটে এসেছিলেন খড়ম পায়ে দিয়ে। তার ব্যবহৃত খড়ম এখনও তার সমাধিস্থল সংলগ্ন স্থাপনায় রক্ষিত আছে।
সনাতন ধর্মেও খড়মের ব্যবহার করে আসছেন অনেকে। প্রাচীন খড়মকে দেবতা, সাধু সন্ন্যাসীদের পদচিহ্নের প্রতীকও মনে করেন অনেকে। জৈন ধর্মেও ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী ও সাধুরা খড়ম পরে চলতেন বলে জানা গেছে।
মূলত এক খণ্ড কাঠ পায়ের মাপে কেটে খড়ম বানানো হয়। সম্মুখভাগে একটি বর্তুলাকার কাঠের গুটি (বউল) বসিয়ে দেওয়া হয়। যা পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও পাশের আঙ্গুলটি দিয়ে আঁকড়ে ধরা হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাঠের গুটির পরিবর্তে রাবারের খণ্ডও ব্যবহার করা হয়। আবার বর্তমানে কাঠের ও রাবারের খণ্ড বাদ দিয়ে খড়মের সামনের অংশে রাবার ও চামড়ার ঢাকনার মতো করে দেওয়া হয়।
খড়ম ব্যবহারকারী বাউল মান্নান জানান, পূর্ব-পুরুষদের স্মৃতি রক্ষা করতেই তার এই খড়ম পায়ে দিয়ে চলা। ১৯৮৫ সাল থেকে বউলযুক্ত খড়ম ব্যবহার করছেন তিনি।
তিনি বলেন, সবকিছুতেই অনেক সাধনা করেছি আমি। সামনে যত দিন বেঁচে আছি খড়ম পরেই চলব। খড়ম পায়ে দিলে আমার শরীর ভালো থাকে। আমি শুনেছি লোকের কাছে ‘কাঠের সাথে লোহার পিরিত, তাইতো ভাসে জলে! প্রেম কইরো না দুইজনের মন সমান না হলে’। আর কাষ্ঠ ও লোহার জন্যই হয়তো আমার শরীরে কোনো অসুখ-বিসুখ নেই।
বাউল মান্নান বলেন, স্বাভাবিক মানুষ চামড়া ও কাপড়ের জুতা পরে যেভাবে হাঁটে, আমিও ঠিক সেভাবে হাঁটি এমনকি খড়ম পরে দৌড়াতেও কষ্ট হয় না।
ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ের জনক ভাণ্ডারি মান্নান। এই পর্যন্ত তিনি নিম, সুন্দরী, সেগুনসহ বিভিন্ন গাছের ১২০ জোড়া খড়ম পরেছেন। এছাড়া তিনি সব সময় চার জোড়া খড়ম ঘরে মজুদ রাখেন।
তবে দামের কারণে বর্তমানে বাজারে খড়ম পাওয়া যায় জানিয়ে এই শিল্পী জানান, বর্তমানে একজোড়া খড়ম মিস্ত্রি খরচ ও কাঠ অনুপাতে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম পড়ে। তবে গৌরাঙ্গ মিস্ত্রি নামের আমার এক ভক্ত আমাকে খড়মগুলো বানিয়ে দেন।
স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল ইসলাম, শাহ আলম সর্দার, হালিমন বেগম বলেন, আমাদের ছোটবেলা থেকেই দেখি মান্নান বাউল খড়ম পায়ে হাঁটেন। তাকে কখনও রোগে পড়তে দেখিনি। এ বয়সে এখনও অনেক সুস্থ আছেন তিনি। খড়ম পায়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে বেড়ান। তিনি কাছাকাছি কোনো হাটবাজার আত্মীয়-স্বজন বা ভক্তের বাড়ি গেলে খড়ম পায়ে হেঁটে যান। সব সময় ভক্তসহ অনেকেই আসেন তাকে দেখতে, তার গান শুনতে। ফলে তার বাড়িতে মানুষের যাতায়াত থাকে সব সময়।
বাউল মান্নানের ভক্তরা জানান, তারা ভক্ত আশেকানরা এখানে আসেন গান-বাজনা শোনেন। তিনি যে গান রচনা করেন সেগুলো শুনতে ভালো লাগে। প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে অনেকেই আসেন। আর সাদা মনের এই মানুষটি খড়ম পরে চলাচল করার পাশাপাশি নীতি কথা বলায় সাধারণ মানুষ আলাদা সম্মানজনক দৃষ্টিতে দেখছেন বলে মত তাদের।
বাউল মান্নানের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, অভাব আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতার কারণে ষষ্ঠ শ্রেণীর বেশি এগোতে না পারলেও তার মেধা মননে অনেক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। নিজেই এক থেকে দেড়শ’র মতো গান লিখেছেন। আবার তাতে সুরও দিয়েছেন। নিজের গান নিজে গেয়ে ভক্ত শ্রোতাদের হৃদয়ও কেড়েছেন। বাউল ভাণ্ডারি লালনগীতিসহ প্রায় ছয়শ’ গান তার হৃদয়ে গাঁথা।
কাগজে কলমে সত্তোরোর্ধ্ব মান্নান জানান, তার গানের ক্যাসেটও রয়েছে। ক্যাসেটের নাম হচ্ছে ‘এক রঙের দুই ফুল’। তবে তিনি অর্থ-সম্পদ, টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি কিছুই চান না, কারণ এর প্রতি কোনো লোভ নেই তার। সূত্র : বাংলানিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।